বাংলাদেশে টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পর গণ অভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী লীগের দিনকাল অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছে তারা। দলটিকে নিষিদ্ধ করতে দাবি তুলছেন অনেকে। এর মধ্যে জোরাল গুঞ্জন, আওয়ামী লীগ নাকি প্রবাসী সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, তারা নাকি ভারতের আগরতলায় সমাবেশেরও আয়োজন করতে যাচ্ছে। সত্যিই কী, তাই করতে চাচ্ছে আওয়ামী লীগ?
একটি সংবাদমাধ্যমের বরাতে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার বক্তব্য পাওয়া গেছে। তাদের দাবি, ভারতের মাটিতে আওয়ামী লীগের সমাবেশেে আয়োজন বা প্রবাসী সরকার গঠন করা কোনোটিরই ভিত্তি নেই। একই রকম মন্তব্য এসেছে ভারত সরকারের তরফ থেকেও।
উল্লেখ্য, গত শনিবার নোয়াখালীতে এক অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ জানান, আগরতলায় সমাবেশ আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। ওই সমাবেশ থেকে দলটি একটি প্রবাসী সরকারের ঘোষণা দিতে পারে। শেখ হাসিনা সেখানে নিজে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখতে পারেন।
একই তথ্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। ওই দিন কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকায় এক সমাবেশে তিনি বলেন- পালিয়ে গিয়েও খুনি হাসিনা দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছেন। আমরা ফ্যাসিবাদের গংদের স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, তাদের ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা কখনোই বাংলার মাটিতে সফল হবে না।
কয়েক দিন ধরে বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বশীল কেউ এখনো এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। আওয়ামী লীগ আসলেই কি আগরতলায় সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে? দলটি যদি সমাবেশের প্রস্তুতি নেয়ও, ভারত সরকার কি ওই ধরনের দলীয় কর্মসূচি করার অনুমতি দেবে?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা বলছেন, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে ভারতের মাটিতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু এমন তথ্য তারা পেলেন কোথা থেকে? এর জবাবে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ বলেন- আমাদের নিজস্ব কানেকশনের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, শনিবার তারা কুমিল্লার কাছে সীমান্তের এক জায়গায় মিটিং করার চেষ্টা করেছিল। জানাজানি হওয়ার কারণে তা আর সফল হয় নাই।
সমাবেশ করার বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে আওয়ামী লীগ নেতারা ইতিমধ্যে তৎপরতা শুরু করেছেন বলেও দাবি করেন সমন্বয়ক মাসুদ। তাদের দাবি অনুযায়ী কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী অঞ্চলের যেসব আওয়ামী নেতা এখনো দেশে অবস্থান করছেন, তাঁরাই ওই বৈঠক করতে চেয়েছিলেন। মাসুদ দাবি করেন, আগরতলায় একটা সমাবেশ করে তারা প্রবাসী সরকার ঘোষণা দিয়ে এই দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করতে চায়।
কিন্তু, বাংলাদেশে যেখানে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ এবং আওয়ামী লীগ কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী নয়, সেখানে তারা কেন প্রবাসী সরকার ঘোষণা করতে যাবে? এমন প্রশ্ন রাখা হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা তার জবাব দিয়েছেন। সমন্বয়ক মাসুদ বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ, কিন্তু তারা নিজেরা তো এখান থেকে পদত্যাগ করে পালিয়েছে গণ-অভ্যুত্থান ও গণবিপ্লবের মুখে জনরোষ থেকে বাঁচতে। মানুষ রক্ত দিয়ে এখন যে সরকারকে বসিয়েছে, তারা সেই সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে চাইছে। এ কারণেই তারা এমন উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে।
এদিকে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন যে, তাঁর মা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেননি। ফলে আওয়ামী লীগ সভাপতিই এখনো বাংলাদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সমন্বয়ক মাসুদ দাবি করেছেন, এ রকম আলোচনা সামনে এনে এখন শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশ সফর করে নেতা-কর্মীদের মনোবল চাঙা করে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টার পরিকল্পনা করছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারকেও জানানো হয়েছে বলে এই সমন্বয়ক জানান।
কী বলছে আওয়ামী লীগ?
আওয়ামী লীগ ভারতের মাটিতে সমাবেশ ও প্রবাসী সরকার ঘোষণা করতে যাচ্ছে বলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন সমন্বয়ক যে দাবি করেছেন, তার কোনো ভিত্তি নেই বলছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, এগুলো সব ভিত্তিহীন, অসত্য এবং প্রোপাগান্ডা।
ক্ষমতা গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকার এখন দেশ চালাতে পারছে না বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সিনিয়র আরেকজন নেতা বলেন, দেশে এখন জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বলে কিছু নেই, আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, অরাজকতা চলছে। মোটকথা, কোনো কিছুর ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।
এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির নেতারা। বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই তারা এখন এসব প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। কিন্তু এসব করে পার পাওয়া যাবে না। ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব অবশ্যই অন্তর্বর্তীকালীন অবৈধ সরকারকে নিতে হবে।
তবে, নেতা-কর্মীদের অনেকে যে ইতিমধ্যে দেশ ছেড়েছেন এবং এখনো ছাড়ার চেষ্টা করছেন, সেটি স্বীকার করেছেন নাছিম।
এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর যেভাবে অত্যাচার-নির্যাতন ও মামলা-হামলা চালানো হচ্ছে, তাতে করে জীবন বাঁচাতে কেউ যদি দেশের বাইরে আশ্রয় নেয়, সেটা কি সে পারে না?’
ভারত কী বলছে?
ভারত সরকারের কর্মকর্তারাও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দাবিকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। ভারত অবশ্য বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে ভারত সরকারের একটি সূত্র প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, ‘কারা বলছেন এসব কথা? তারা কি কোনো দায়িত্বপূর্ণ পদে আছেন? পাশের দেশে যে কেউ একটা আজগুবি কথা বললেই আমরা কেন জবাব দিতে যাব?’
এ ধরনের দাবির যে কোনো ভিত্তি নেই, সেটা অবশ্য ত্রিপুরা ও দিল্লিতে নানা মহলে খোঁজখবর নিয়েও নিশ্চিত হওয়া গেছে। প্রথমত, আওয়ামী লীগের পালিয়ে আসা নেতা-কর্মীরা যদি ত্রিপুরার মাটিতে বড় মাপের কোনো সমাবেশ করতে চান, সেটা একেবারে গোপনে বা স্থানীয়দের কাউকে টের পেতে না দিয়ে করা সম্ভব নয়। ত্রিপুরার সরকারি ও বেসরকারি একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, রাজধানী আগরতলায় এ ধরনের কোনো তৎপরতা গত কয়েক সপ্তাহে তাদের আদৌ চোখে পড়েনি।
দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ যদি ভারতের মাটিতে কোনো প্রকাশ্য সভা করেও, সেখানে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে ভাষণ দিতে দেওয়া হবে, সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তাছাড়া গত আড়াই মাসে ভারত বারবার এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে, এক বিশেষ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে নিজের সুরক্ষার জন্য শেখ হাসিনাকে ভারতে চলে আসতে হয়েছে এবং তখন তাকে আতিথেয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তাঁকে প্রকাশ্য রাজনীতিতে অংশ নিতে দেওয়া হবে, ভারত এখনো এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
ফলে প্রকাশ্য কোনো রাজনৈতিক সভায় শেখ হাসিনা ভাষণ দিলে বা তার অডিও বার্তা প্রচার করা হলে দিল্লির জন্য তা কূটনৈতিকভাবে খুবই অস্বস্তিকর হবে। ফলে শেখ হাসিনাকে এমন কোনো কাজ করতে আপাতত অনুমতি দিতে চায় না ভারত।
তৃতীয়ত, ৫ আগস্টের পালাবদলের পর আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী পালিয়ে ভারতে চলে এসেছেন এটা ঠিকই। এদের অনেকেরই আগে থেকে ভারতের ভিসা ছিল, কেউ কেউ আবার এসেছেন বিশেষ ব্যবস্থায়।
জানা গেছে, ভারত তাদের সবাইকেই অনানুষ্ঠানিকভাবে লো প্রোফাইল বজায় রেখে চলার নির্দেশ দিয়েছে, প্রকাশ্য কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতেও নিষেধ করা হয়েছে তাদের। রাতারাতি সেই অবস্থান পরিবর্তন করে ভারতের মাটিতে সমাবেশ করতে উৎসাহ দেওয়া হবে এমন কোনো কারণ ঘটেনি।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলেছে, ‘আওয়ামী লীগ ভারতের মাটিতে শক্তি সঞ্চয় করে বাংলাদেশে ফিরে আসতে চাইছে, এ জন্যই সীমান্তের খুব কাছে সভা-সমাবেশ করছে—বাংলাদেশের মানুষকে আওয়ামী জুজু দেখাতেই এগুলো বলা, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। আমাদের সেই ফাঁদে পা দেওয়ার কোনো কারণ নেই!’
—তথ্যসূত্র বিবিসি বাংলা
previous post