বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার জায়গায় তারা নতুন ঘোষণা চায়, মুক্তিযুদ্ধের রক্তে পাওয়া সংবিধান ফেলে দিয়ে নতুন সংবিধান চায়, ইয়াহিয়া খানের মতই নিষিদ্ধ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু সংগঠন ছাত্রলীগ।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ডানহাত হিসেবে কাজ করা ছাত্রলীগকে দ্বিতীয়বারের মতো নিষিদ্ধ হতে হলো।
প্রথমবার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর, দ্বিতীয়বার মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের সিদ্ধান্তে যারা ক্ষমতায় এসে প্রথম মাসেই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিপক্ষে অস্ত্র ধরা জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংবিধান রক্ষা, সংরক্ষণ ও মেনে চলার শপথ নিয়ে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে, তার মেয়াদ হতে পারে সর্বোচ্চ ১৮০ দিন।
সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে, সেটি দৈব দুর্বিপাকে করা না গেলে পরের ৯০ দিনে করতে হবে।
কিন্তু এই সরকারের এজেন্ডায় অন্য কিছু। তারা সংবিধানের এই বিধান অনুযায়ী চলার কোনো ইচ্ছাই পোষণ করছে না, বরং যা যা করছে, তার নেপথ্যের উদ্দেশ্য যে আসলে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে অস্বীকার করা তা ধীরে ধীরে ফুটে উঠেছে।
সরকারবিরোধী আন্দোলনের ছক সাজানো হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সামনে রেখে। আড়াই মাসের ব্যবধানেই এই শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ সীমিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে লোক এসে মিছিল সমাবেশ করে থাকে।

ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে ইদানীং লোকবল হচ্ছে না। কিন্তু তাদেরকে দিয়ে নানা দাবি তুলে তা বাস্তবায়ন করছে ইউনূস সরকার।
২২ অক্টোবর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কয়েকশ লোকের সমাবেশে যে পাঁচ দফা দাবি তারা তুলে ধরেছে তা স্পষ্টতই ১৯৭১কে অস্বীকার করা আর সেটি যে রাষ্ট্রদ্রোহ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে দেখে নেই তাদের পাঁচ দফায় কী আছে।
প্রথম দাবি: ‘মুজিববাদী সংবিধান’ অর্থাৎ ৭২ সালের সংবিধান বাতিল করে দিয়ে নতুন করে সংবিধান লিখতে হবে।
দ্বিতীয় দাবি, এই সপ্তাহের মধ্যে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নিষিদ্ধ করতে হবে;
তৃতীয় দাবি: ‘ফ্যাসিবাদী’ সংবিধানের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে এই সপ্তাহের মধ্যে পদচ্যুত করতে হবে।
চতুর্থ দাবি: অভ্যুত্থানের স্পিরিট ও ‘জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটের আলোকে’ চব্বিশ পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই সপ্তাহের মধ্যে ‘প্রোক্লেমেশন অব রিপাবলিক’ অর্থাৎ জাতির ঘোষণাপত্র জারি করতে হবে। সেটির ভিত্তিতে এবং সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে’
এবং
পঞ্চম দাবি. বিগত তিনটি নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকারের প্রমাণ
পাঁচটি দাবির বিশ্লেষণ যদি করা হয়, তাহলে প্রথম আর চতুর্থ দাবিটি মূলত ১৯৭১ সংশ্লিষ্ট। ৩০ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় হয়েছে, সেটির একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র ছিল। সেটিই বাংলাদেশের ঘোষণা।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর যে দেশ পরিচালনায় ১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচনা করা হয়েছে, সেটির আলোকেই বাংলাদেশ শাসিত হয়ে আসছে, সেটির আলোকেই মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার শপথ নিয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের এই দুই মূল উপড়ে ফেলতে চাইছে।
এই মূল কারা উপড়ে ফেলতে চায়? গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির বিভাজনে যখন স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির আলোচনা সামনে এসেছে, তখন অনেকেই বলেছে, এত বছর পর স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি আর থাকে না।
এই পাঁচ দফা দাবির দুটি দফায় স্পষ্টতই ১৯৭১ বিরোধিতা। বাংলাদেশের মূলে আঘাতের শামিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর আগেই শুরু হয় ছাত্রলীগের প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি। ৩ মার্চই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর অস্ত্র হাতে তুলে নেয় সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে স্বাধীন বাংলা সরকার গঠন হয়, সেটি ১০ই এপ্রিলই বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র অনুমোদন করে।
সেই ঘোষণাপত্রের আলোকেই পরিচালিত হয় মুক্তিযুদ্ধ, ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন হয় দেশ। সেই ঘোষণাপত্রেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করে তাকে তার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কলা বলা হয়।
অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের এই ভিত্তিটাকে অস্বীকার করে নতুন ঘোষণাপত্র চাইছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যারা নেতা হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূসকে বেছে নেওয়ার আগে তিনি এবারের আন্দোলনকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ আখ্যা দিয়ে বসেন।
৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে দেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেই দেশের শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান রচনা করা হয় সংক্ষিপ্ততম সময়ে।
ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার ২ বছর ১১ মাস ১৭ দিন পর ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম সংবিধান পায় ভারত।
পাকিস্তানের জন্য সংবিধান তৈরি করতে সময় লেগে যায় ৯ বছর। তবে ১৯৫৬ সালের সংবিধানটি দুই বছর পরেই রদ হয়ে যায় সামরিক শাসনে।
সেই হিসেবে বাংলাদেশ অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে তার শাসনতন্ত্র রচনা করতে পেরেছে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে এই সংবিধান গৃহীত হয়, কার্যকর হয় অভ্যুদয়ের এক বছর পূর্তির দিন ১৬ ডিসেম্বর।
সংবিধানে সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন সব দেশেই হয়ে থাকে। যুগে যুগ নতুন চিন্তা আসে, সেই হিসাবে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ সব সময় আছে। কিন্তু ইউনূস সরকার ও তার ছাত্র বাহিনী এই সংবিধানকে অস্বীকার করে সেটি বাতিল করতে চাওয়া মানে ৭১কে অস্বীকার করার আরেক প্রমাণ।
এরই মধ্যে ইউনূস সরকার যে ৮টি জাতীয় দিবস বাতিল করেছে, তার দুটি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে জড়িত। একটি হল ৭ মার্চ, যেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, অপরটি হল সেই সংবিধান দিবস।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান কেন গায়ে জ্বালা ধরে, সেই সমীকরণ মেলানো আসলে খুব কঠিন বিষয় না।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় দাবি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা। এটিও ইয়াহিয়া খানের প্রশাসনে করেছিল। রাজনৈতিক সংঘাতে প্রাণহানির ঘটনাকে নজিরবিহীনভাবে ‘গণহত্যা’ হিসেবে বিচার করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করেছে ইউনূস সরকার।
সেই ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর করা হয়েছে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের আইনজীবী তাজুল ইসলামকে। অর্থাৎ জামায়াত নেতাদের বিচারের প্রতিশোধ হবে এবার। সেই আইনজীবী ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে বার বার ‘রুপি’ বলছিলে, যেটি আসলে পাকিস্তানের মুদ্রার নাম, বাংলাদেশের মুদ্রা যে টাকা, সেটি তার না জানার কথা না। আনন্দের আতিশয্যে কত কিছুই বলে ফেলছেন তারা।
ট্রাইব্যুনালেও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, কিন্তু আইনজীবী ছাড়াই একতরফা বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাও আদালতের আদেশের অপেক্ষা না করে ইউনূস সরকার তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে প্রধান অবদান রাখা ছাত্র সংগঠনটিকে সন্ত্রাসী হিসেবে নিষিদ্ধ করে দিল।
ইয়াহিয়া খানের পর ইউনূসের চোখে ছাত্রলীগ হলো ‘সন্ত্রাসী সত্তা’।
তৃতীয় দাবি অনুযায়ী যদি ‘ফ্যাসিস্ট’ সংবিধানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিনকে সরে যেতে হয়, তাহলে এই সংবিধান সংরক্ষণ ও মেনে চলার অঙ্গীকার করে ইউনূস সরকার নিজেই ‘ফ্যাসিস্ট’। সরে যেতে হবে তাকেও।
মির্জা ফখরুল ভোটে অযোগ্য হবে? জিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অবৈধ হবে?
পঞ্চম দাবি মেনে নিয়ে গত তিনটি নির্বাচন যদি বাতিল করতে হয়, সেই নির্বাচনে জয়ীদের যদি ভোটে অযোগ্য ঘোষণা করতে হয়, তাহলে ১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনও বাতিল করতে হবে।
২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিরোধীরা আসেনি, একতরফা ভোট হয়েছে। ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনও একতরফা হয়েছে, বিরোধীরা আসেনি।
১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আছে, যদি ২০১৮ সালের নির্বাচন বাতিল করতে হয়, একই যুক্তিতে বাতিল করতে হবে বাকি দুটি নির্বাচনও।
২০১৮ সালের নির্বাচনে কিন্তু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বগুড়া-৬ আসন থেকে জিতেছিলেন, তাকেও কি নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে?
১৯৭৮ সালের যে নির্বাচনে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হন, সেই নির্বাচনে জিয়ার পক্ষে ভোট দেখানো হয় ৭৭ শতাংশ। ১৯৭০ সালের যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয় পায়, সেটিতেও দলটি ৭৭ শতাংশ ভোট পায়নি।
সেই নির্বাচন বাতিল ঘোষণা হবে না?