ইউনূস সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আনন্দের সঙ্গেই যোগ দিয়েছিল বিএনপি। সরকারকে দিয়েছিল নিরঙ্কুশ সমর্থন। তবে নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের অবস্থান দেখে এখন বিরোধী দলের ভূমিকায় দলটি।
এনওয়াই বাংলালাইফ বিশ্লেষণ
মেটিকুলাস ডিজাইনের আন্দোলন গড়ে ক্ষমতায় আসা মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের আসল উদ্দেশ্য যে নির্বাচন ছিল না, সেটি যারা বোঝার প্রথম দিনই বুঝেছে। কিন্তু আনন্দের অতিশয্যে বিএনপি বুঝেও বুঝতে চায়নি।
আড়াই মাস পরে এসে নেতারা এখন প্রকাশ্যেই প্রশ্ন তুলছেন। সরকারের পাহাড়সম ব্যর্থতার কথা সামনে তুলে এনে জানতে চাইছেন ইউনূস আসলে কী চান?
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আগস্ট থেকেই একটু একটু করে নির্বাচন চাইতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার এই দাবিতে পাত্তা দেয়নি ইউনূস সরকার। এখন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় থেকে শুরু করে আরও অনেকেই কথাগুলো তুলছেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে একাধিক সংলাপে বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে বললেও সরকার কর্ণপাত করছে না
এর মধ্যে দলটির কনিষ্ঠ নেত্রী হলেও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা রুমিন ফারহানা আর রাখঢাক না রেখেই প্রশ্ন তুলেছেন, ইউনূস সরকারের উদ্দেশ্যটা কী?
বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসির টকশোতে ঝাঁঝাল বক্তব্যে তিনি তুলোধুনা করেছেন সরকারকে। বলেছেন, ‘যার যেটা কাজ নয়, তাকে সেই জায়গায় বসিয়ে তাকে দিয়ে সেটা করানোর যে ব্যর্থ চেষ্টা এটা তো তিন মাসেই প্রমাণ হয়েছে যে সম্ভব নয়, তারপরেও একটা চলছে।’
ইউনূস সরকার ক্ষমতায় বসতে না বসতেই দেশের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চল প্রলয়ংকরী বন্যায় আক্রান্ত নয়। ত্রাণ তৎপরতায় সরকারের নজিরবিহীন ব্যর্থতা ভুলিয়ে দেয় সাধারণ মানুষের দান।
এরপর মুখ রক্ষা করতে গিয়ে সরকার বলতে থাকে, তারা পুনর্বাসন করবে। কিন্তু পানি নেমে যাওয়ার দুই মাস পরেও পুনর্বাসন পরে থাক, ভেঙে যাওয়া রাস্তাগুলো মেরামতের ন্যূনতম কোনো উদ্যোগ নেই। কুমিল্লা ও ফেনী অঞ্চলের মানুষের চলাচলই এখন কঠিন।
খোদ ঢাকা শহরে একটু ফাঁকা সড়ক পেলেই দিনে দুপুরে ছিনতাই, কোপাকুপি চলছে, দোকানে ঢুকে টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিচ্ছে, সমন্বয়ক পরিচয়ে বাড়িতে ঢুকে লুট করছে সর্বস্ব।
এ নিয়ে সমালোচনার জবাবে দিয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘আজকে যদি পুলিশ ঠিকভাবে কাজ না করে, হাসিনার দোষ। আজকে যদি আদালত অঙ্গণে হামলা হয় হাসিনার দোষ। দ্রব্যমূল্য যদি বাড়ে, হাসিনার দোষ।’
শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া পুলিশকে তিনি বলেছেন ‘পুলিশ লীগ’, তার দাবি এই বাহিনী গণ অভ্যুত্থানের স্পিরিটে কাজ করছে না।
অথচ দেখা যাচ্ছে সাবেক আইজিপি থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভার স্বচ্ছ ব্যক্তিদেরকেও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদেরকেও জেলে পুরা হচ্ছে, মোহাম্মদপুরের সন্ত্রাসীদের ধরতে গেলেই পারছে না।
আসিফ নজরুলের যুক্তি অভিনব। তিনি বলেছেন, ‘সিন্ডিকেট তারা করে গেছে। এই সিন্ডিকেট ভাঙা একদিনের কাজ? বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ১০টা দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়।’
সরকার আসলে চাচ্ছেটা কী?
সরকারকে উদ্দেশ্য করে রুমিন ফারহানার জিজ্ঞাসা, ‘আপনি আসলে চাচ্ছেন কী?’
পরে আবার বলেছেন, ‘নির্বাচনের পথে যে তারা কয়েক মাসের মধ্যে হাঁটবে না সেটা বুঝে গেছি। নির্বাচন যে তাদের এজেন্ডা বা প্রায়োরিটি লিস্টের মধ্যে নাই, এইটুকু অন্তত আমরা বুঝে গেছি। তাহলে তারা কী চাইছে? তারা কি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকতে চাইছে?
‘এতে তাদের লাভটা কী, তাদের শক্তিটা কী? পেছনে কারা কাছে, কারা তাদের মদদ দিচ্ছে? কারা তাদেরকে বোঝাচ্ছে যে রাজনীতিটা রাজনীতিবিদদের হাতে থাকবার দরকার নেই, এটা তাদের হাতেই থাকুক?’
সরকার কী চাইছে বোঝালেন আসিফ নজরুল
আসিফ নজরুলের বক্তব্যেও কিন্তু উঠে এসেছে এসব নির্বাচন তাদের চিন্তাতেও নেই। তিনি বলেন, ‘শুধু নির্বাচনের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এত মানুষ জীবন দেননি।’
গণতন্ত্র দুই ধরনের মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, ‘একটি হচ্ছে ন্যূনতম গণতন্ত্র, যেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতার হাতবদল হবে। আরেকটি হচ্ছে উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র, যেখানে প্রতিটি নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান স্বাধীন ও কার্যকর থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর হাতে সবকিছু কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকবে না।’
আইন উপদেষ্টার মতে, ‘উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র চাইলে শুধু নির্বাচন দিলে হবে না, কিছু সংস্কার করতে হবে। এত বছর দেশের কোনো রাজনৈতিক দল এসব সংস্কার করেনি।’
সবচেয়ে শক্তিশালী মাহফুজ আলম?
আওয়ামী লীগ সরকারের তুমুল সমালোচক জিয়া হাসান তার ফেসবুক লেখনিতে তুলে ধরেছেন আরেক কাহিনি। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তিনি লিখেছেন, “আমি বাংলাদেশ ঘুরে এসে দেখলাম, মাহফুজ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি।
সরকারের অ্যাডভাইজার কে হবে, কে হবে না, রিফর্ম কমিশনের চিফ বা সদস্য কে হবে না সেইটা মাহফুজ আলম নির্ধারণ করছেন। অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন কমিশন চিফ কথায় বলছিলেন, ‘মাহফুজ আমাকে কোনো কাজই করতে দিচ্ছেন না। সে ডিসাইড করছে কোন মেম্বার থাকবে, কী প্রোগ্রাম হবে, কীভাবে আমি কাজ করব’।”
জিয়া হাসান এই কথাটা কিন্তু বাংলাদেশে থাকতে লেখেননি, লিখেছেন দেশের বাইরে গিয়ে। তার মধ্যে কি কোনো ভয় কাজ করছিল?
আর বিএনপিকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করা ইউনূস সরকার যে এখন দলটিকে পাত্তা দিচ্ছে না, সেটি জিয়া হাসানের আরেক স্ট্যাটাসে ফুটে উঠেছে।
তিনি লিখেছেন, “বাংলাদেশে থাকতে আমি একটা আলোচনায় মির্জা ফখরুলের একটা কোট শুনেছিলাম যে, ‘উনারা (সরকার) তো আমার ফোনও ধরে না’।”
গাং পার হলে মাঝি কোন শালা- বাংলায় একটি প্রবাদ আছে। অর্থাৎ কাজ শেষ হয়ে গেলে আর গুরুত্ব পায় না। বিএনপির অবস্থা কি এমন হলো?
‘মবের মুল্লুক’
সরকার পতনের আড়াই মাস পরে হঠাৎ করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পেছনে লেগেছে ইউনূস সরকার। ছাত্রদেরকে দিয়ে দাবি তুলিয়ে তাকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। মুশকিল হল বিএনপি প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করে বসেছে। তারা পুরোপুরি অসাংবিধানিক শাসন চায় না। এখন ইউনূস সরকার পাকে পড়া ভেড়ার মত আচরণ করছে।
রুমিন ফারহানা একেবারে ধুয়ে দিয়েছেন সরকারকে। তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি হিসেবে আজকে আমাকে পছন্দ হলো আমি বসে যাব, কালকে আপনাকে পছন্দ হবে আপনি বসে যাবেন রাষ্ট্রপতি পদে? এটা কি একটা মবের মুল্লুক?’
ইউনূস সরকারের কৌশলটা বিএনপি যে এতদিনে ধরতে পেরেছে, সেটিও তুলে ধরেন দলটির নেত্রী।
তিনি বলেছেন, “ওনারা (সরকার) যা চায়, ছাত্ররা এসে বিশৃঙ্খলা করুক। সচিবালয়ে করে, শাহবাগে করে, আমার বাড়ি এলিফেন্ট রোডে, এখানে এসে করে। সারা ঢাকাবাসী নাকাল হয়ে যায় যানজটে, অসুস্থ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায় অ্যাম্বুলেন্সগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। কারও কোনো টু শব্দ করার সাহস নাই।
“ওনারা বিভিন্ন জায়গায় বসে যান, প্রটেস্ট করে, দাবি নামা পেশ করে এবং ২৪ ঘণ্টা পার না হতে সেই দাবিটা মানা হচ্ছে, যেন আলোচনা করে ঠিক করা হয় যে, ‘আপনারা ওখানে গিয়ে বসেন, আমরা বলব আপনাদের দাবি অনুযায়ী আমরা কাজটা করে দিচ্ছি’।”
ছাত্রলীগে নিষিদ্ধে বিএনপিতে ভয়?
ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ পরিচয়ে ইউনূস সরকার ঠিক এই কৌশলে নিষিদ্ধ করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শ পাঁচেক মানুষের মিছিল থেকে দাবি তোলা হয়েছে। দুই দিনের মাথায় সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে দেয়।
পোড় খাওয়া রাজনীতিক গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কিন্তু মেসেজটা বুঝতে পেরেছেন। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ ব্যান (নিষিদ্ধ) করেছে। একদম শেষ। আমরা আপত্তি করছি না, নাকি খুশি হচ্ছি? কালকে যদি বিএনপি ব্যান করে তখন আমরা কী করব?’
রুমিন ফারহানা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এই নিষিদ্ধ করার ম্যান্ডেট, অধিকারটা তাদেরকে কে দিল?’
তিনি বলেন, ‘যারা অপরাধ করেছেন, দেশে ফৌজদারি আইন আছে। কিন্তু গোটা সংগঠনকে কীভাবে নিষিদ্ধ করেন? নিষিদ্ধ করার আগে কি মানুষের মতামত নিয়েছেন? রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়েছেন? একটা রাজনৈতিক দলও তো বলেনি।’
‘প্রত্যেকটা মানুষ একটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এই নতুন বাংলাদেশ মানে এই না যে আজকে আমাদের একে পছন্দ না, একে নিষিদ্ধ করলাম, তাকে পছন্দ হয় না, তাকে নিষিদ্ধ করলাম’, বলেন তিনি।