মেয়েদের হলের গেটের সামনে অবস্থান করে পোশাক নিয়ে কটূক্তি করা হয়েছে, গায়ে হাত তোলা হয়েছে, গোটা ক্যাম্পাসে মূত্রত্যাগ করা হয়েছে যেখানে সেখানে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছিল ভয়ে। অভিযোগ পেয়েও পদক্ষেপ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘ইসলামি সম্মেলন’কে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের জন্য গেছে বিব্রতকর আর ভয়ের একটি দিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে মেয়েদের কটূক্তি করা হয়েছে, এমনকি গায়ে হাত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাদের হলের সামনে অবস্থান নিয়ে বের হওয়ার ও ঢুকার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়েছে। মেয়েদের হলের সামনে প্রকাশ্যে মূত্র ত্যাগ করা হয়েছে।

সরকার পতনের পর থেকে কথিত বহিরাগত ঠেকাতে যেসব তৎপরতা আর হুমকি ধমকির কথা শোনা গেছে, তার কোনো কিছুই দেখা গেল না দিনভর।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই আলেম-ওলামার মহাসম্মেলনের ডাক দেওয়া হয়েছিল তাবলিগ, কওমি মাদ্রাসা ও দ্বীন রক্ষার কথা বলে। তবে ধর্মকে কেন কার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে, এই প্রশ্নের সদুত্তর না থাকলেও সমাবেশের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে তাবলীগ জামাতের যে বিভক্তি, তাতে মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীদেরকে হুমকি ধমকি দেওয়াই এই জমায়েতের উদ্দেশ্যে।
গত কয়েক বছর ধরেই তাবলিগে এই বিভক্তি দেখা দিয়েছে। স্মার্টফোন ব্যবহার করা যাবে না, কোরআন শিক্ষা দিয়ে অর্থ নেওয়া যাবে না- মাওলানা সাদের এমন আরও কিছু বক্তব্য সামনে আসার পর এই বিভেদ দেখা দেয়।
এই মাওলানা সাদ বিশ্ব তাবলীগ জামাতের আমির, তার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন বাংলাদেশের মাওলানা জোবায়েরুল হাসানের অনুসারীরা।
এই ভেদাভেদে এর আগে ঢাকায় বিমানবন্দর সড়কে অবরোধ হয়েছে, টঙ্গীতে মারামারিতে প্রাণহানি হয়েছে, পরে দু্ পক্ষে আলাদাভাবে ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। এই সমাবেশে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে জানুয়ারির শেষ ও ফেব্রুয়ারির শুরুতে যে ইজতেমা হতে যাচ্ছে, সেখানে মাওলানা সাদপন্থিদেরকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
ইসলামের নামে জমায়েত করে শেষমেশ হুমকি ধমকি দিয়েই আয়োজন শেষ হয়েছে।
সে যাই হোক, ইসলামপন্থিদের ইজতেমা নিয়ে এই বিভেদে এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিতে অস্থির সময়ে নারীরা আছে বিশেষভাবে নিরাপত্তাহীনতায়।
পোশাকের জন্য পথে পথে হেনস্তা এমনকি শারীরিকভাবে আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে অসংখ্য। কিন্তু এর প্রতিকারের জন্য কোথায় গেলে কাজ হবে, এই প্রশ্নের জবাব নেই। ফেসবুকে লিখেই প্রতিবাদ করছেন ভুক্তভোগীরা।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের পরিস্থিতি অন্তত কিছুটা ভালো ছিল। কিন্তু তাদের যে দিন পার করতে হয়েছে, সেটি ভুলে যেতে চান অনেকে।
রোকেয়া হলের একজন ছাত্রী একজন নারী সাংবাদিককে মেসেজ দিয়ে বলেছেন, ‘আপু মহা সমাবেশ হচ্ছে সোহরাওয়ার্দীতে। কিন্তু আমাদের ক্যাম্পাসে হাঁটার জায়গা নেই। মেয়েদের উল্টা পাল্টা অনেক কথা বলছে। খুবই নিরাপত্তাহীন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে।’

আরেকজন মেয়ে বলেছেন, ‘হলের গেইটে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছি না।’
শামসুন্নাহার হলের সামনের যে রাস্তা দিয়ে মেয়েরা যাতায়াত করে, সেখানে প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগ করেছে সমাবেশে আসা শত শত মানুষ। এই কাজ করা হয়েছে রোকেয়া হলের দেয়ালে, করা হয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দেয়ালে।

যত্রতত্র বিরিয়ানির প্যাকেট ফেলে নোংরা করা আর মূত্রত্যাগই নয়, আতর টুপির দোকান খুলে বরা হয়েছে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে।

কবি সুফিয়া কামাল হলের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মেহজাবিন লিয়া নিজ হলের সামনেই ‘মন্দ স্পর্শের’ শিকার হয়েছেন। তার মতে আরও অনেকেই এর শিকার হয়েছে।
তিনি টিউশনির জন্য হলের বাইরে বেরিয়েছিলেন। সমাবেশে আসা একদল মানুষ ছিল ফটকের সামনে। তাদের একজন তাকে বাম পাশ থেকে ইচ্ছা করে সজোরে ধাক্কা দিয়েছে।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ-২’ নামের একটি ফেসবুক পেইজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাজিয়া নিপা লেখেন, আজকে ক্যাম্পাসি দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলাম। অশালীন কোনো ড্রেস পরিনি। ওরনাসহ শালীন ড্রেসই পরেছি। অথচ দাড়ি টুপি পরা একজন দেখে বলল, উউফফফ। তাকানোর ধরনটা আর নাই বললাম।’
বিভিন্ন বিভাগে গিয়েও মেয়েদের কটূক্তি করা হয়েছে, মেয়েদের টয়লেটে ঢুকে পড়েছে ছেলেরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার পেজে মাহজাবীন লিখেছেন, “হুজুররা ডিপার্টমেন্টের ফিমেল ওয়াশরুমে চলে যাচ্ছে, মেয়েদের ‘ওড়না কই’ বলে হ্যারাস করছে, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছে৷ পিও শিক্ষার্থী সংসদে এসব নিয়ে পোস্ট দিলে তারা আমুলীগ আর শাহবাগী ট্যাগ দিচ্ছে৷ কথায় কথায় খালি ‘ফাস তারিকের আগে আমুলীগের সম্মেলনের সুমায় কুতায় ছিলেন?’ বলে চিৎকার করে উঠছেন৷ গ্রুপের নাম বদল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৌহিদি সংসদ রেখে দেন না হয়৷
“ভালো কথা, শিক্ষার্থী সংসদের সেই প্যাট্রোল ডিজেল বাহিনী কুতায় একন?”
কবি সুফিয়া কামাল হলের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী জিকরা জিকু ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “ঢাবিকে হিসুখানা না বানাইলেও পারতেন!”
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ-২’পেজে রবিউল ইসলাম ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশে আসা লোকজনের মূত্রত্যাগের ছবি দিয়ে লিখেছেন “বাদ গেল না নজরুলের সমাধির মসজিদের পাশ, না সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, না মেয়েদের হলের দেয়াল, না থিয়েটার ডিপার্টমেন্ট এর সাইডটা, না গেল টিএসসির সাইড।’

প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদের কাছে অভিযোগ নিয়ে গেছেন ভুক্তভোগীরা। জানিয়েছেন, তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা, বাজে মন্তব্য করা হয়েছে, এমনকি গায়ে হাত পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ নিয়ে গেছে ছেলে শিক্ষার্থীরাও। তারা জানিয়েছে সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের দিকে আসা-যাওয়া করতে সমস্যায় পড়েছে।
তবে প্রক্টরের আসলে এই সময়ে কিছু করার সুযোগ নেই। তিনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে-এমন কথা বলে প্রবোধ দিয়েছেন।
ইজতেমার এক পক্ষকে ঠেকাতে কর্মদিবসে আরেক পক্ষের ইসলামি সম্মেলনের নামে এই শক্তি প্রদর্শনে রাজধানীবাসীর ভোগান্তিরও ছিল না শেষ। তীব্র যানজটে ভুগতে হয়েছে মানুষকে।
সকাল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে বাস ও ট্রাক ভরে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ লোকজন সম্মেলনস্থলে জড়ো হতে থাকেন। সকাল ১০টার মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানমুখী রাস্তাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এই জমায়েত শুক্র বা শনিবার করা যেত, এমন কথা ফেসবুকে লিখেছেন অনেকেই।
সম্মেলনে আসা মানুষের ঢলের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রেস ক্লাব, মৎস্যভবন থেকে শাহবাগ হয়ে সায়েন্সল্যাব এবং শাহবাগ থেকে বাংলামোটর দিকের সড়কের পেরিয়ে এই বাড়তি জটলার প্রভাব পড়ে সারা ঢাকাজুড়ে।