বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আজ বিশেষ একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে নারীবাদ। এক সময় যা শুরু হয়েছিল কেবল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, এখন তা সমাজের নানাভাবে পিছিয়ে পড়া ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের আন্দোলনের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারাণভাবে বলা হয়, ১৮৪০ সালে নারীবাদ আন্দোলনের সূচনা। অ্যামেরিকায় নারীদের ভোটাধিকারের দাবিতে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল।
১৯৬০‑এর দশকে নারীবাদ আন্দোলনের দ্বিতীয় ওয়েভ শুরু হয়। নারী মুক্তি, আইনের চোখে নারীর সমতা ইত্যাদিই ছিল এই পর্বের মূল কথা। আর ১৯৯০‑এর দশককে নারীবাদের তৃতীয় পর্ব হিসেবে দেখা যায়। এই যুগের নারীরা আগের সংস্কারপন্থীদের চেয়ে অনেক বেশি বিদ্রোহী। ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনাচার নিয়ে তাঁরা অনেক বেশি স্বতন্ত্র। জীবনের প্রতিটি স্তর থেকে পুরুষের আধিপত্যের অবসান করতে চেয়েছিলেন তাঁরা।
এই সময়ে নারীবাদ বিশ্বের বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। এর আগের দুই পর্বের নারীবাদী আন্দোলন ছিল ইউরোপ-অ্যামেরিকা কেন্দ্রিক। তখন নারীবাদীদের প্রায় সব শক্তিশালী কণ্ঠস্বর ছিল শ্বেতাঙ্গ ও আর্থিকভাবে ধনী। তাদের ভাবনার মূলে লিঙ্গ বৈষম্য বা নারী-পুরুষের অধিকারের অসাম্য ছিল প্রধান।
হিউম্যান রাইটস ক্যারিয়ারসের এক প্রবন্ধে বলা হয়, ঠিক এই সময়ে ১৯৮৯ সালে ‘ইন্টারসেকশনালিটি’ নামের একটি ধারণা জনপ্রিয় হয়। কৃষ্ণাঙ্গ আইনবিদ কিম্বার্লে ক্রেনশো সর্বপ্রথম এই পরিভাষাটি ব্যবহার করেন। এর দ্বারা তিনি বলতে চাইলেন, এখন পর্যন্ত যত নারীবাদী আন্দোলন হয়েছে, তাতে কৃষ্ণাঙ্গ নারী, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নারী ও দরিদ্র নারীদের বঞ্চনার কথা গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়নি। এখন আমাদের সব শ্রেণি, বর্ণ ও গোষ্ঠীর কথা বলতে হবে।
বর্তমানে নারীবাদ কোন পর্যায়ে আছে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও অধিকারকর্মীরা একমত নন। অনেকে বলছেন, এখন আমরা তৃতীয় ও চতুর্থ পর্বের মাঝামাঝি একটা রূপান্তরকালে আছি। কিন্তু তা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশের মতে, নারীবাদকে এভাবে পর্বে পর্বে ভাগ করে দেখাটা সমস্যাজনক। এভাবে দেখা অনেক বেশি পশ্চিমা, শ্বেতাঙ্গ ও মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক। কারণ এতে আন্দোলনের পরিসর ছোট হয়ে পড়ে। কারণ নারীবাদ আন্দোলন ১৮৪০ সালে শুরু হয়েছে বলে ধরে নিলে তার আগে হওয়া নারী অধিকার আদায়ের অনেক সংগ্রাম বাদ পড়ে যায়।
যা হোক, বর্তমান নারীবাদী আন্দোলন অনেকটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থানের সঙ্গে যুক্ত। সোশ্যাল মিডিয়ার এই পালাবদল সমাজের অন্য অনেক কিছুর মতো নারীদের অধিকার, বঞ্চনা ও নীপিড়ন এবং শোষিত হওয়া নিয়ে নতুন করে ভাববার সুযোগ করে দিয়েছে।
অনেকে বর্তমান নারীবাদী আন্দোলনকে ২০০৬ সাল থেকে শুরু হওয়া ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চান। কিন্তু অধিকারকর্মীদের আরেকটি অংশ নারীদের চলমান লড়াইকে অনেক বেশি বড় ও জটিল পরিসর থেকে দেখতে চান। তাঁরা নারীবাদকে সব ধরনের প্রান্তিক গোষ্ঠীর অধিকারের লড়াইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চান।
অধিকারকর্মীরা এলজিবিটিকিউ, ইরান-আফগানিস্তানের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারবঞ্চিত নারী, যৌনকর্মী, কর্মক্ষেত্র-সংগঠন-দলে নারীর প্রতি বৈষম্য, শ্রমিক শ্রেণিসহ সব ধরনের সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন এবং তাঁদের অধিকার আদায়ে কাজ করেন।
এই অবস্থায় চলমান নারীবাদী আন্দোলন অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে এক অঞ্চলের সঙ্গে বিশ্বের আরেক অঞ্চলের দ্রুত যোগাযোগ ও সংহতি তৈরি হওয়ায় তা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। এখনকার নারী আন্দোলনের মূল কথা, অধিকার, সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে মানুষে‑মানুষে কোনোভাবেই ভেদাভেদ বৈষম্য করা যাবে না।
সব ধরনের বৈষম্য, নিপীড়ন, অত্যাচার ও হুমকি-ধামকির বিরুদ্ধে নারীবাদের অবস্থান। তাই এটি কেবল নারীর একক কোনো বিষয় নয়। বরং এটি সমাজকে একটি বিশেষ পরিস্থিতি থেকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বলা যায়।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, হিউম্যান রাইটস ক্যারিয়ারস, বিবিসি
previous post