লুৎফুন নাহার লতা, লেখক
যে জীবন সাধারন মানুষের আবরনে অসাধারন হয়ে ওঠে, অথবা অসাধারন এক মানবীর অতি সাধারন জীবনযাপন আমাকে বিস্ময়ে বিমুঢ় করে। আজ শুধু নয় সেই ১৯৮০ সাল থেকেই তাঁকে যত দেখেছি ততই অবাক হই। মুগ্ধ হই। তিনি এই উপমহাদেশের এক অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, শেখ হাসিনা।
তিনি ১৯৪৭ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বরে গোপালগঞ্জের টুঙগীপাড়ায় জন্ম গ্রহন করেন। তিনি যখন এই দেশের আলো হাওয়ায় চোখ মেলেন সেই সময়টা ছিল বড় দু:সময়। বৃটিশরা এদেশের মানুষকে দু’শো বছরের গোলামী শেষে, বিপ্লবী হবার অপরাধে হত্যা করে গাছে গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে বিদায় নিচ্ছে।
তারা ধর্মের নামে একটি ভয়াবহ বিষবাস্প ছড়িয়ে দিয়েছে এই উপমহাদেশে। সেই ১৯৪২ থেকে চলছে হত্যার মহোৎসব। হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ধর্মের বিভেদের কারনে একে অপরকে হত্যার, রক্ত পাতের এক নিদারুণ অপমানিত সময়।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়।
বৃটিশেরা যেখানেই গেছে এই কূটনৈতিক চাল গুলো চেলে ধ্বংস করে দিয়ে এসেছে সে জাতীর একতা। পৃথিবীর কোথাও বড় কোন শক্তি তারা গড়ে উঠতে দেয়নি। আজো দেয়না। ঠিক তেমনি ধর্মের ভিত্তিতে এক সুপরিকল্পিত ভাঙনের বীজ বুনে দিয়ে স্বাধীনতার নামে ভারত পাকিস্তান ভাগ করেছে। পাকিস্তানকে আবার দুই দিগন্তের দুই অংশে ভাগ করেছে।
ইতিহাসে ধর্মের নামে দেশভাগ এর মত নিকৃষ্ট আর কিছু নেই। ১৯৪৭ এ হল ভারত পাকিস্তান আলাদা দুই দেশ। মানুষ গুলোকে যেতে হল হৃৎপিণ্ড ছেড়া কষ্ট নিয়ে শেকড় বাকড় উপড়ে ইন্ডিয়া থেকে পাকিস্তান আর পাকিস্তান থেকে ইন্ডিয়া। নিজ দেশ, নিজ মাটি, নিজ সংস্কৃতি থেকে দূরে। ধর্মের কাছে বলী হয়ে গেল দুটি জাতি। আপন ভিটা ছেড়ে দূরে বহু দূরে।
শেখ হাসিনা যখন জন্ম নিয়েছেন তখন নিশ্চয়ই দাঙ্গার ভয়ে শতশত বছরের পুরনো ভিটেমাটি ছেড়ে পালাচ্ছিল খুলনা, যশোর, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার হাজারো মানুষ। কেবল তো টুঙ্গিপাড়া নয়, সারাদেশ থেকেই চলে যাচ্ছে বনেদী হিন্দু পরিবারগুলো। ভারতের নানান এলাকা থেকে বাড়িঘর এওয়াজ বদল করে দলে দলে চলে আসছে ওপারের বাঙালী মোহাজের মুসলমানেরা। সব কিছু মিলে তখন এক ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজমান এই উপমহাদেশে।
সেই অস্থিতিশীল সময়ে তিনি জন্মেছিলেন এক সাধারন মধ্যবিত্ত মায়াভরা বাঙালী পরিবারে। যেখানে বিত্তবিলাস না থাকলেও ছিল সভ্যতা, মানবতা আর মায়ামমতা। বাবার রাজনীতি সেই মাটির কাছের সহজ সরল মানুষগুলোর জীবনে দীর্ঘ বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে শিখিয়েছিল। সারা পূর্ব বাংলা জুড়ে উঠেছিল প্রতিবাদের ঝড়। সেই ঝড়ের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে ১৯৭১ সালে এদেশের মানুষের জীবনের দামে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ।
মাঝে মাঝে ভাবি, এই যে সেই একটি রাজনৈতিক ডামডোলের ভিতর তিনি
জন্মেছিলেন,তৎকালীন সমাজের কুসংস্কার অনুসারে বঙ্গবন্ধুর প্রথম সন্তান, কন্যা হয়েছে বলে কি কেউ হতাশ হয়েছিলেন? ওনার পিতা কিম্বা পিতামহ কি ভেবেছিলেন অন্যরকম কিছু! জানিনা আমরা সেকথা, তবে বুঝি বাঙালী মধ্যবিত্ত সাধারন পরিবারের আশা আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্নের কথা। কন্যা সন্তান যে একদিন পূত্রের চেয়েও বড় কাজ করতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ শেখ হাসিনা।
১৯৭১ এ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর গনহত্যায় এই দেশ হয়ে যায় এক রক্তাক্ত প্রান্তর। সেই সাথে যুক্ত হয় এদেশের বিশ্বাসঘাতক, রাজাকার, আলবদর মৌলবাদী চক্রের ভয়াবহ সহযোগিতা। তারা নিজেরা এই সকল হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানের পক্ষে। দেশের মানুষকে হত্যা করে, ধরিয়ে দেয়, ধরে নিয়ে আসে এবং হত্যায় সহায়তা করে। মেয়েদেরকে ঘর থেকে, স্কুল থেকে, কলেজ থেকে ধরে নিয়ে উপঢৌকন হিসেবে দিয়ে আসে পাকিস্তান আর্মির ক্যাম্পে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস লাখো নারীর জীবনকে তারা দুর্বিষহ নরকে পরিনত করে তোলে।
এদেশের আপামর জনগণের সাহায্যে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে ভারতের সহায়তায় অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা ছিনিয়ে আনে এদেশের স্বাধীনতা। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামী জনগণ বঙ্গবন্ধুকে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত করিয়েছিল। তিনি জন্ম দিয়েছিলেন এই দেশের। সারা পৃথিবী বিস্ময়ে চেয়ে দেখেছে গোপালগঞ্জের এক সাধারণ পরিবারের সন্তান কিভাবে তাঁর নিজের দেশের মানুষের অধিকার আদায় করে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কখনোই ভুলে যাননি তিনি বাংলার সাধারণ জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করেন।
এমন পিতার সন্তান হিসেবেও তিনি কিন্তু পড়তে যেতে পারেননি যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে। হার্ভার্ড বা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পশ্চিমা শিক্ষা দীক্ষায় গড়তে পারেননি নিজেকে। জওহরলাল নেহেরু যেমন গড়ে তুলেছিলেন কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে। বঙ্গবন্ধু কিন্তু ভুলেও ভাবেননি তাঁর এই কন্যাটি একদিন দুনিয়া কাঁপানো দৃঢ়তায় পরিচালনা করবে এই দেশ। বরং মাত্র একুশ বছর বয়েসে তরুন বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়ার সাথে একান্তই পারিবারিক ইচ্ছেয় বিয়ে করতে হয়েছিল তাঁকে। বিয়ে করেছিলেন সাধারন শাড়ী আর ফুলের গয়না পরে।
পরিবারে তিনি ছিলেন ছোটদের হাসুবু! মা চাচী ফুপুদের কাছে আদরের হাসু। সেই সহজ সরল সবার সাথে মিশে থাকা হাসি খুশি মমতাময়ী হাসু বু, তাঁর ভাইদেরকে, বা একমাত্র বোনকে কোলে নিয়ে ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছেন। মাকে সাহায্য করেছেন ঘরের কাজে। বাড়িতে বাবার রাজনৈতিক মিছিল মিটিঙের লোকেদের জন্যে নাস্তা তৈরি করেছেন, দফায় দফায় বিরতি হীন চা বানিয়েছেন। ঘর পরিস্কার করেছেন, রান্না করেছেন, শিল পাটায় বেটেছেন পরমাত্মীয়দের বিয়ের মেহেদি। এসব গল্প নয়, এর প্রমান জানে সারা দেশ। জানে গোটা পৃথিবী।
তখনকার মধ্যবিত্ত আটপৌরে বাঙালী পরিবারগুলোর মতই ছিল বঙ্গবন্ধুর সন্তানদের বেড়ে ওঠার বেলা। সাধারণ পরিবার গুলোর চেয়েও বাবার জীবন জেলে জেলে কেটেছে বলে ওনারা কম পেয়ে বড় হয়েছিলেন। কম জামাকাপড়, কম বিলাসিতা, কম আরাম আয়েশ। বেগম মুজিবকে অপরিসীম মানসিক ও অর্থনৈতিক কষ্টের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর সন্তানদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। আজো শেখ হাসিনা তাঁর পরিবারের শিক্ষা আর নিজের ভিতরে লালন করা বাঙালির সংস্কৃতি নিয়েই ঋদ্ধ হয়ে আছেন। আর কি আশ্চর্য, তিনি আজো সুযোগ পেলেই নিজ হাতে সব করেন।
না ভাইয়েরা তার নেই। নেই বাবা। নেই মা। আত্মীয় পরিজনের অনেকেই নেই! সেই শোক বুকে নিয়েও তিনি হাসি মুখে রান্না করতে ভালোবাসেন। সবাইকে পাতে তুলে তুলে খাওয়াতে ভালোবাসেন। তিনি এভাবেই মায়ের মত পরম মমতা নিয়েই আছেন বাংলার মানুষের পাশে। তিনি বাংলার সাধারন মানুষের প্রানের নেতা। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা।
তখন তিনি বিরোধী দলীয় নেত্রী। মিন্টু রোডের বাসায় মাত্র উঠেছেন। সেসময় একদিন সারাদেশের গন্যমান্য সবাইকে ডেকেছেন মত বিনিময় করতে। বাইরে বিশাল সামিয়ানা টানিয়ে সবার বসার ব্যবস্থা হয়েছে। আমি যখন গেলাম অনুষ্ঠান প্রায় শেষের পথে। সবাই একে একে বিদায় নিলেন। আপা ঘরে ঢোকার মুখে দরজার কাছে তসলিমা নাসরিন আর আমাকে দেখে ডেকে নিলেন ভিতরে।
ওনার চাচাত ভাই খুলনার শেখ হেলাল ওর বোন আর অন্যান্য কাজিনেরা সবাই সেদিন ছিলেন। একপর্যায়ে তসলিমাও চলে গেলেন। বাড়ি ভর্তি লোক। রাত বেড়ে চলল আমি বেরিয়ে আসতে চাইলে আপা বললেন একটু থাকো। বাবুর্চিকে ডেকে টেবিলে সবার খাবার দিতে বললেন। তারপর সবাইকে নিয়ে খেতে বসলেন। নিজের হাতে তুলে দিলেন সবার পাতে। শুধু সেই একবার নয় আরো বহুবার আমি দেখেছি তাঁর মাতৃরূপ!
ভালোবাসার, রাগের, দু:খের, আবেগের, অভিমানের রঙ কি আমার জানা নেই। জানতেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, পাবলো পিকাসো, হেনরি মাতিস, ভিন্সেন্ট ভ্যান গ আর আমাদের সুলতান। জানিনা বলে আজ আর তাঁকে বলার আমার কিছু নেই।
তিনি এই মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের কাছে হেরে গেলেন যারা সারা দেশবাসীকে প্রতারণা করেছে। ঘূনাক্ষরেও বুঝলেন না ওরা ছাত্র নয়! ওরা সব জামাত, শিবির! যাদের মাস্টার মাইন্ড ছিল হিজবুত তাহরির এর সদস্য! যাদের প্রতারণা কলাকৌশল ছিল “amazing meticulously designed thing, not just suddenly came —– it was very well desined.” Dr Yunus.
আজ আর কিছু কি বলার আছে!!
আপনার জন্যে প্রার্থনা করি আপনি সুস্থ থাকেন। আমাদের কিছু চাইবার নেই কারো কাছেই। সূর্যের মত জ্বাজ্জল্যমান এই টুকুই শুধু চাই। জয়বাংলা’র জয়। মাথার উপরে বঙ্গবন্ধুর ছবি। চাই মানবতার জয়। চাই মৌলবাদের অন্ধকারকে দীর্ণ করে অভ্রভেদী আলো আসুক। আকাশ বাতাস প্লাবিত হোক কল্যানের ঝর্ণাধারায়। কারন ১৯৭১ কে রিপ্লেস করা যায়না।
শুভ জন্মদিন আপনাকে।