প্রীতিলতা বসু
তোফাজ্জল খুব আগ্রহ নিয়েই খাচ্ছিলো৷ হয়তো অনেক সময় ধরে না খাওয়া ছিল৷ তোফাজ্জলে যে প্লেটে ভাত খাচ্ছিলো, তার বাইরেও আরেকটা বোলে ভাত আর আরেকটা বাটিতে ডাল ছিল৷ সে কি সবগুলো ভাত খেয়েছিলো? জানিনা৷ প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজে পরে কি ঘটেছিলো দেখা যায়নি৷
বলছিলাম তোফাজ্জলের কথা যাকে ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র পিটিয়ে হত্যা করেছে৷
সেদিন দুপুরে ক্রিকেট খেলা চলাকালীন সময়ে ৬টা মোবাইল চুরি হয়ে যায়। পরবর্তীতে ৮টার দিকে তোফাজ্জল হলে ঢুকলে তাঁকে আটক করেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের ধারণা, তোফাজ্জলই মোবাইল চুরি করছে। তাকে গেস্টরুমে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং হালকা মারধর করেন শিক্ষার্থীদের কয়েকজন। পরবর্তীতে তাকে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে আবারো গেস্টরুম নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়৷
তোফাজ্জল বাড়ি বরিশালের বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠাল তলি ইউনিয়নে। তাঁর বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন বলে জানা গেছে।
তোফাজ্জলের ভাইয়ের বউ জানিয়েছে, মারধরের এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা তাকে ফোন করে বলে যে, তারা তোফাজ্জলকে ফোন চুরির দায়ে আটক করেছে৷ দুইলাখ টাকা দিলে তাকে ছেড়ে দিবে৷ কিন্তু ওই বিধবা মহিলার পক্ষে কোনভাবেই দুইলাখ টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না৷ সে শুধু তাদেরকে অনুরোধ করে যে তাকে মারধর না করে যাতে পুলিশের হাতে তুলে দেয়৷ তবে কি টাকার জন্যই তোফাজ্জলকে মারা হলো?
সেইদিনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদকে কয়েকজন শিক্ষার্থী নামের সন্ত্রাসী পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।
জানা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ঢাকা–আরিচা মহাসড়কের পাশে কারও জন্য অপেক্ষায় ছিলেন শামীম৷ হঠাৎ পেছন থেকে তিনজন এসে তাকে জাপটে ধরে মারধর শুরু করেন। এরপর আরও চার দফায় বেধড়ক মারধরের পর তাকে পুলিশে দেয়া হয়। তাকে মারধরের ঘটনার সূত্রপাত বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে হলেও রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় প্রক্টরিয়াল বডি। এই কয়েক ঘন্টা শামীমকে কোথায় নেয়া হয়েছিল কিংবা কিভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল, জানা যায়নি৷ এরপর পুলিশ শামীমকে হাসপাতালে নিলে রাত সোয়া ৯টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
এই মাসের ৮ তারিখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় সন্ত্রাসী সন্দেহে দুই যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেছে স্থানীয়রা।
৪ সেপ্টেম্বর রাতে সাড়ে খুলনার সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তিন বাহিনীর সদস্যদের সামনে কিশোর উৎসবকে থানার বেদম পেটানো হয়৷
প্রথমে ধারনা করা হয়েছিলো, উৎসব মারা গেছে৷ পরে জানা যায়, সে পুলিশ কাস্টোডিতে আছে৷ তবে, তার চোখ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷
বিক্ষুব্ধ জনগনকে থামাতেই নাকি পুলিশ তার নিহত হওয়ার খবর রটিয়েছিল৷ অসহায় পুলিশ!!!
গনপিটুনি ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজার মন্দির আক্রান্ত হচ্ছে৷ সরকার পরিবর্তনের পর পর মন্দির পাহারা দেওয়ার দৃশ্য দেখছে দেশবাসি৷ ওইগুলি হয়েছে এক ধরনের আইওয়াস৷ এমন ও হয়েছে রাতভর মন্দির পাহারা দেওয়ার নামে দুর্বত্তরা হিন্দু পরিবারের মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে ধর্ষণ করেছে৷
অন্যদিকে, গোলাপ শাহ, দেওয়ানবাগ, বিবি সখিনার মাজারসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাজার ভাঙা হয়েছে৷ শাহ পরান মাজারে গান বাজনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷
ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, এবং প্রসিদ্ধ স্থাপত্যগুলিকে লক্ষ্য করে ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগ গভীরভাবে বসে থাকা অসন্তোষ এবং অনিয়ন্ত্রিত জনগনের আচরণ প্রকাশ করছে।
গত কয়েকদিন ধরে বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা দেশের আপামর জনগনের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে, তারা যে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এই বোধটা তৈরি করেছে৷
প্রতিহিংসা স্পৃহা কিংবা বিচার ব্যাবস্থার প্রতি অনাস্থার কারণে যেখানে রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনা ক্রমবর্ধমান জনগণের বিভিন্ন অংশের দ্বারা ক্রমবর্ধমান সহিংস এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের দিকে পরিচালিত করেছে।
বাংলাদেশে এই প্রথম নয়, এর আগে গনপিটুনি কিংবা মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আমিনবাজারে কয়েকজন তরুনের গনপিটুনি৷ সেইদিন ছিল, শবে বরাতের দিন৷ ওই তরুনরা ঘুরতে বের হয়েছিল, যেটা আমাদের দেশের ছেলেরা স্বাভাবিকভাবেই শবেবরাতের রাতে ঘুরতে বের হয়ে থাকে, এটাই রেওয়াজ৷ কিন্ত ২০১১ সালের শবেবরাতের ওইরাতে ওই যুবকদেরকে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷
শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে থাকে৷ ভারত, পাকিস্তান এবং আফ্রিকার দেশগুলি অন্যতম৷
এখন পর্যন্ত ভারতের মাত্র তিনটি রাজ্য মণিপুর, পশ্চিমবঙ্গ এবং রাজস্থান মব হত্যা বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করেছে।
পাকিস্থানে ব্লাস্ফেমিয়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মবের মাধ্যমে হত্যা নতুন কিছু নয়৷
এই বছরের ২১ শে জুন ব্লাসফেমির অভিযোগে উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানে এক পর্যটককে পুলিশ স্টেশন থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
উগান্ডা সরকার মব জাস্টিস কিংবা জনতার বিচারের সমস্যা সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১৯ সালে, জনতার সহিংসতায় অংশগ্রহণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে একটি আইন পাস করা হয়েছিল। পাশাপাশি সরকার জনসচেতনতামূলক প্রচারণাও শুরু করেছে যাতে জনগণকে জনগণের ন্যায়বিচারের বিপদ সম্পর্কে শিক্ষিত করা যায়।
বাংলাদেশে এখন চারদিকে আরজকতা৷ কোথাও স্বস্তি নেই৷ সরকারে আছে কিংবা মাত্রারিক্ত আশাবাদী মানুষ ছাড়া কেউ বলবেনা দেশে ভালো আছে৷
বাংলাদেশের চলমান এই অবস্থাকে অনেকেই মব জাস্টিস কিংবা মবোক্রেসি হিসেবে আখ্যায়িত করছে৷
অনেকটা মগের মুল্লুক আর কি৷ ১৬-১৭ শতকে এই দেশে আরাকান রাজ্য তথা বার্মা তথা বর্তমান মায়ানমার থেকে মগরা এই দেশে এসে খুন রাহাজানির মত ঘটনা ঘটাতো৷
মগরা আমাদের অঞ্চলে এসে যে অরাজকতার সৃষ্টি করতো তার মাত্রা বোঝানোর জন্য বলা হতো মগের মুল্লুক অর্থাৎ যা খুশি তাই করার দেশ। অনেকের মতে মগ মানেই আরাকানী আর মগের মুল্লুক মানে আরকান রাজ্য।
এখনো সেই অবস্থা চলছে যে যার মত চলছে৷ হত্যা করছে, লুট করছে, ধর্ষন করছে, এদেরকে থামানোর কেউ নেই৷
দেশে কি আসলে কোন সরকার আছে কিনা বোঝা মুস্কিল৷
পার্থক্য একটাই ওই সময় মগ তথা মগরা বাইরে থেকে আসতো আর এখন দেশের মধ্যেই আছে৷
দ্রোহ কিংবা বিদ্রোহের আগে এবং পরে আপনি একই আচরণ করতে পারেন না৷ দ্রোহ হলো সব ভেঙে চুড়ে পরিবর্তন আনা৷ আর বিজয় অজর্ণের পর হলো গড়ার সময়৷
এই অবস্থা কাটিয়ে উঠার জন্য সরকারকে খুব দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে৷
প্রথমত, মামলার সময়মত ও নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগের সক্ষমতা ও স্বাধীনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, জনতার সহিংসতা প্রতিরোধ করতে এবং প্রতিক্রিয়াকে স্বাগত জানাবে এমনভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি সংস্কার করা৷ তৃতীয়ত, জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান এবং সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে জনগণকে জনগণ মব জাস্টিসের কুফল এবং আইনী প্রক্রিয়াগুলি মেনে চলার গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করার জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে। পরিশেষে, আইনি সংস্কারে অবশ্যই অন্তর্নিহিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের সমাধান করতে হবে৷
পরিশেষে বলবো, প্রফেসর ইউনুস নামী লোক৷ অনেক বলে তার পুরস্কারের তালিকা মুখস্থ করতে অনেক সময় লাগবে৷ এত নন্দিত লোক উনি, উনাকে ঠিক করতে তার শাসনকাল মবের মুল্লুক নাকি জনগনের সরকার হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাবে৷
সময় গড়াচ্ছে দ্রুত, সেই সাথে সরকারের জনপ্রিয়তা ও কমছে৷ মাত্র দেড় মাসের মাথায় দেশের ৫১ শতাংশ মানুষ এই সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে৷ (সুত্র: প্রথম আলো জরিপ)৷
খুব দ্রত জনগনের পার্লস বুঝতে হবে৷ দেশের মানুষের আকাশসমান প্রত্যাশা পুরন করা সহজ কাজ নয় বৈকি৷