মেয়েদের রাস্তাঘাটে কটূক্তি করা হচ্ছে পোশাক নিয়ে, হুমকি ধমকি দেওয়া হচ্ছে এমনকি আদালতেও এই বিষয়গুলো ঘটছে। প্রতিকার না পেয়ে ভুক্তভোগীরা ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন, কিন্তু ব্যবস্থা নেবে কে?
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
ঢাকা আইনজীবী সমিতির এক নেতা এক নবীন নারী আইনজীবীকে ডেকে নিয়ে বলেছেন, ‘তোমার চুলের রং লাল করেছ কেন?’
এটা আমার পছন্দের-জবাব দিলেন সেই নারী আইনজীবী। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইনজীবী সমিতি ভেঙে দিয়ে নিজেরা নিজেদের নেতা ঘোষণা করে ফেলেন বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক আইনজীবীরা। তাদের সেই নেতা তখন বলেন, ‘চুলের রং কালো করবা’।
সেই আইনজীবী এমন আচরণে ক্ষিপ্ত হলেও তিনি কোনো অভিযোগ করেননি। কারণ, তাতে তার আইন পেশায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে বলে ভাবছেন।
আদালতের যখন এই অবস্থা, তখন বাইরের চিত্র কেমন তা জানা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে নারীদের অভিজ্ঞতার লেখালেখিতে।
বিশেষ করে তরুণীরা পথে ঘাটেই যেসব কটূক্তি, আর বাজে আচরণের শিকার হচ্ছেন, সে সব পত্রপত্রিকায় জায়গা পাচ্ছে না। শুরুর দিকে মুখ বুজে সহ্য করলেও এখন একের পর এক বাজে অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছেন।
তারা পোশাক বা অন্য বেশভূষার কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু প্রতিকার কোথায়, সে প্রশ্ন তুলছেন তারা। কেউ একজন বাজে অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরার পর কমেন্টে অন্যরা তুলে ধরছেন তাদের কথা। কিন্তু সরকারের কোনো সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি, উপদেষ্টারা যথারীতি নীরব।
সরকার পতনের পর থেকে কিছু বিষয়ে নিত্যদিন বক্তব্য দিচ্ছেন উপদেষ্টারা। কিন্তু দল বেঁধে পিটিয়ে মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে নিত্যদিন; ‘ব্যবস্থা নেওয়া হবে’, ‘কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে’, ‘সরকার এসব সহ্য করবে না’- এসব বক্তব্য দেওয়ার পর কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না।
কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে একজনকে পিটিয়ে হত্যার পর ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ছাত্রলীগেরই নেতাকে।
এক নারী পর্বতারোহীকে প্রকাশ্য হেনস্তা করা হয়েছে ধানমন্ডির মত এলাকায়, এ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, সিসিটিভি ফুটেজে ঘটনাটি রেকর্ড হয়েছে, কিন্তু পুলিশের কোনো তৎপরতা নেই।
এই অবস্থায় হেনস্থার শিকার নারীরা অসহায়ত্বই কেবল প্রকাশ করছেন। এদের অনেকেই আবার সরকার পতন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন, এমনকি শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর গণভবনে গিয়ে তার শাড়ি নিয়ে এসে ফেসবুকে পোস্টও দিয়েছেন, এমন একজনও আছেন।
তারা বলছেন, তাদের পোশাক-আশাক; সাজসজ্জা ও রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে একটি মহল। বিষয়টি স্পষ্টত নারীর ওপর ধর্মীয় মৌলবাদী আক্রমণ।
অভিজ্ঞতা করুণ
বেসরকারি চাকরিজীবী সামিরা আক্তার বলছেন, তিনি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার দুই থেকে তিনদিন পর মহাখালীর ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন। তখন তার পরনে ছিল শার্ট, জিন্স আর কেডস। সে সময় কিছু ছেলে তাকে দেখে কটূক্তি শুরু করে।
তিনি বলেন, ‘আমি সবসময়ই এ ধরনের পোশাক পড়ে বাইরে বের হই। কিন্তু কখনও এ ধরনের আচরণ হয়নি আমার সঙ্গে। তারা বলছিল, তোকে তো সুযোগে পেয়ে নেই।’
প্রতিবাদ করলে হিতে বিপরীত হবে ভেবে শুনেও না শোনার ভান করে সেদিন সেখান থেকে দ্রুত হেঁটে চলে আসেন সামিরা। তবে সেদিনের সেই ঘটনাটি তার মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
তিনি বলেন, ‘সেদিন বিকেলে কয়েকজন নারী সহকর্মীকে নিয়ে বাইরে গিয়েছিলাম। তখনও কতগুলো ছেলে অশ্লীল কথাবার্তা বলে আমাদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছিল। আমাদের এখন বাইরে বের হতে ভয় হয়।’
মিরপুরের বাসিন্দা সামিয়া রহমান গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে টিশার্ট, প্যান্ট আর ওড়না পড়ে বাইরে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। তখন জোব্বা পরা এক বয়স্ক লোক তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন।
সামিয়া বলেন, ‘তিনি আমার সামনে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন; তারপর আবার ফিরে দেখতে থাকে। মনে হচ্ছিল লোকজন ডেকে আমার উপর আক্রমণ করবেন। তিনি খুবই আক্রমণাত্মক ছিলেন। পরে তিনটি পাগলাটে কুকুর দৌড়ে আসার পর তিনি ভয়ে চলে যান।’
গত ১৫ অগাস্ট অগাথা মন্ডল নামের এক উদ্যোক্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেন, তার আগের দিন সকাল ৯টা তিনি মিরপুর ১১ মেট্রো স্টেশনের নিচে দাঁড়িয়ে ছোট বোনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখন এক লোক কথা বলতে পারেন না ভান করে তার কাছে ভিক্ষা চাচ্ছিল, কিন্তু লোকটিকে ভিক্ষুক মনে হয়নি। লোকটি অন্যদের কাছেও ভিক্ষা চাচ্ছিল।
এর মধ্যে দুয়েকজন টাকা দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে মানুষ কমে যাওয়ার পর লোকটি কথা বলা শুরু করেন এবং বলেন, ‘আপু টাকা দেন ভাত খাব।’
পরে অগাথা তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনি এতক্ষণ না বোবা সেজে ছিলেন! যেই মানুষ জন সরে গেছে এখন কথা বলা শুরু করলেন!’ এরপর লোকটি অগাথাকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেন।
অগাথা লিখেন, ‘আমি রিয়্যাক্ট করার আগেই এক আংকেল এসে পরেন। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছে। আমি তাকে বলতে গেলে-লোকটা বলেন, ‘আংকেল আমি আপনার ছেলের বয়সী তো, উনার (আমার) কথা শুনার আগে আপনারে একটা জিনিস বলি।
এই যে দেখেন, মেয়ে মানুষ জিন্স পরে বের হইসে, মাথায় কাপড় নাই। আপনি বলেন এইটা কি ঠিক? আমি আরো মানুষ ডাকতেসি, তারাও দেখে বলুক, এইটা কি ঠিক?’ আংকেল খুব ভদ্রভাবে উনাকে বলেন, ‘ও কী পরসে তা তোমার না দেখলেও হবে’।”
পরে লোকটি রিক্সাওয়ালাদের বলে লোকজড়ো করার চেষ্টা করে। তখন অগাথা মেট্রোরেল স্টেশনের ভেতর চলে যান।
অগাথা তার ফেইসবুকে লিখেন, ‘আমার কপাল ভাল ছিল তাই মব ক্রিয়েট হবার আগেই আমি সরে আসতে পেরেছি; আমার কপাল ভালো ছিল তাই আংকেল এত সেন্সিবল ছিলেন। আংকেল উনার কথায় তাল দিলে তখন ওখান থেকে আমি বের হতাম কীভাবে?’
লামিশা জামান নামের এক তরুণী সম্প্রতি তার ফেইসবুকে লিখেন, ‘আমার ২০ বছরের জীবনে যত কথা রাস্তায় মেয়ে হিসেবে শোনা লাগসে তার ৩ গুণ বেশি ইদানীং শুনতে হয়।’
এই তরুণী অংশ নিয়েছিলেন ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবে, গিয়েছিলেন গণভবনেও। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাড়িও নিয়ে এসেছিলেন।
লামিশা লিখেন, সম্প্রতি রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময় এক গ্রুপ মধ্যবয়সী পুরুষ তাকে দেখে ‘ওড়না কই?’ বলে চিৎকার করে উঠে। আর রাস্তার মানুষজন সেটি উপভোগ করছিল এবং হাসছিল।
‘আমি এখনো এই ট্রমা থেকে উঠতে পারতেসি না।’
এর আগে তিনি শাড়ি পরে ঢাকার বাংলামোটর এলাকায় যান, শাড়ির ফাঁক দিয়ে তার শরীরের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিল। তখন একদল হুজুর তাকে দেখে বলে, ‘ঠিক মত শাড়ি পর।’
লামিশা লিখেন, ‘আমি দিনের পর দিন ভোর ৫ টায় বাসা থেকে একা বের হইসি। আমার এখন সাড়ে ৬ টার সময় বাসা থেকে ফার্মগেট যাইতেও ভয় লাগে কারণ তখন রাস্তায় কম মানুষ থাকে।’
তিনি জানান, তার এক ‘আপুকে’ ইচ্ছামতো ঝাড়ি দেয়া হয়েছে, কারণ তিনি রিকশায় সিগারেট ধরিয়েছেন। তারা বলছিল, ‘বিড়ি ধরাইসে মাইয়া মানুষ হইয়া!’