সরকার পতনের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্নে বেপরোয়া আক্রমণ হচ্ছে। ইউনূস সরকার চুপ করে থাকার মধ্যে এবার ৫ বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া এই মুক্তিযোদ্ধার সমাধিতে আক্রমণ হল।
এনওয়াই বাংলা নিউয
নিজস্ব প্রতিবেদক,
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতিচিহ্নে বেপরোয়া আক্রমণের মধ্যে এবার এমন একটি ঘটনা ঘটল যা সব সভ্যতা ও শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
পাঁচ বছর আগেই এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে যাওয়া চট্টগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা মইন উদ্দীন খান বাদলের কবরেও ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই ঘটনাটির একটি ভিডিও ছড়িয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। ঘটনাটি দেশে শিউরে উঠেছে মানুষ। যথারীতি হামলা, ভাঙচুর, হত্যাযজ্ঞ নিয়ে চুপ করে থাকা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের কোনো রা নেই এই ঘটনায়।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পশ্চিম সারোয়াতলী গ্রামে নিজ বাড়িতে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন একাত্তরের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি তার রাজনৈতিক জীবনের পুরোটা সময় পাকিস্তান পন্থা ও উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে কথা বলে গেছেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিন থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্য, ম্যুরাল, জাদুঘরে নির্বিচারে হামলা ভাঙচুরর মধ্যে দেড় মাস পর বাদলের সমাধিতে এই হামলার ঘটনা ঘটে।
মঙ্গলবার দুপুরে একদল মানুষ বাদলের কবরেও হামলা করে। তারা গাড়িতে করে গিয়ে কবরস্থানে গাছ উপড়ে ফেলে। এরপর কবরের নাম ফলক ও পাকা করা কবরটি ভাঙচুর করে সেখানে আগুন লাগিয়ে দেয়।
গত ১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির দিন থেকেই ভাঙচুরের পাশাপাশি আগুন দেওয়া হতে থাকে সরকারি স্থাপনায়। সরকার পতনের পর থেকে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী বা প্রভাবশালীদের বাড়িঘর ও শিল্প কারখানাতেও দেখা গেছে ভাঙচুরের পর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই ধারাবাহিকতা বাদ গেল না কবরের ক্ষেত্রেও।
কবরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। সেখানে দেখা যায়, কবরের দেয়ালে লাগানো টাইলস ভাঙা হচ্ছে। মাঝখানে আগুনের ধোঁয়া বের হচ্ছে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়া বাদল ষাটের দশকে ছাত্রলীগের ‘নিউক্লিয়াসে’ যুক্ত হন। একাত্তরে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধের অন্যতম নেতৃত্বদাতা ছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন বাদল। মাঝে কিছু দিন তিনি বাসদেও ছিলেন। এরশাদের সামরিক শাসনের সময় তাকে কারাগারে যেতে হয়।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসন থেকে ২০০৮ সালে মহাজোটের মনোনয়ন পান শরিক দল জাসদের নেতা বাদল। নৌকা প্রতীকে তার বড় জয়ের মধ্য দিয়ে ওই আসনে বিএনপির দীর্ঘদিনের আধিপত্যের অবসান ঘটে।
এরপর ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আরও দুই বার তিনি আসনের এমপি নির্বাচিত হয়ে সংসদে যান। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে দৃপ্ত বক্তব্য দেওয়া বাদল সমাদৃত ছিলেন একজন দক্ষ পার্লামেন্টেরিয়ান হিসেবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল গঠনেও তার ভূমিকা ছিল।
২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর ভারতের বেঙ্গালুরুতে নারায়ণ ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্সেস হাসপাতালে মারা যান ৬৭ বছর বছর বয়সী এই রাজনীতিক।
বাদলের মৃত্যুর পর এই আসনে উপনির্বাচনে তার দলের কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তার স্ত্রী সেলিনা খান থাকেন ঢাকায়। বাড়িতে থাকেন বাদলের ভাইয়েরা।
দেবরের কাছ থেকেই সেলিনা তার স্বামীর কবরে হামলার কথা জানতে পারেন। এরপর তিনি ফেসবুকে লেখেন, “বাংলাদেশ কি মগের মুল্লুক হয়ে গেল? জীবিত মানুষদের অকাতরে হত্যা করে শান্তি হচ্ছে না। এখন কবরেও মানুষ শান্তিতে থাকতে পারবে না। এত অন্যায় আল্লাহ সহ্য করবে না। এই বাংলাদেশ আমি অন্তত চাই না…”
পুলিশকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে। সেখানে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরায় ফুটেজে যে গাড়িতে করে হামলাকারীরা এসেছিল, সেটি ধরা পড়েছে। গাড়ির নম্বরও স্পষ্ট, হামলাকারীদের চেহারাও আছে তাতে।
কিন্তু পুলিশ কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারেনি। বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম সরোয়ার সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলে তাদের বাহিনীর সদস্যরা গেছে। কিছু আলামতও সংগ্রহ করেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে ইউনূস সরকারের পুলিশ মূলত ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা এমনকি সাবেক বিচারপতি, সাংবাদিক এমনকি বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তারে ব্যস্ত।
বিস্ময়কর হল আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে দূরতম সম্পর্কও না থাকা লেখক, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যিনি বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। কেন তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে, এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করছে না সরকারের কেউ।
এই সাংবাদিকের মতই মুক্তিযোদ্ধা বাদলও বরাবর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন, উগ্র মৌলবাদী ও রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। শাহরিয়ার কবিরকে গ্রেপ্তারের পর বাদলের কবরে হামলার এই ঘটনাটি সমান্তরাল কিনা, সে বিষয়েও প্রশ্ন আছে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নে হামলা নিয়ে সরকারের কেউ কিছু বলছে না, যদিও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম নিজেই একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।
বরগুনায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করেছেন জেলা বিএনপির সভাপতির ছেলে, প্রবীণ মানুষটিকে থাপ্পড় দিয়েছেন তিনি, কিন্তু লাঞ্ছনাকারীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না।
নির্বিকার ইউনূস সরকার সংস্কার সংস্কার বলে যাচ্ছে, কিন্তু কী করতে যাচ্ছে তা স্পষ্ট না। তবে আক্রমণের মুখে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন, মুক্তিযোদ্ধারা।