ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জব) পিটিয়ে দুইজনকে হত্যা করার ঘটনা ঘটে। নিহত দুজনের মধ্যে একজন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এবং অন্যজন মানসিক ভারসাম্যহীন বলে জানা গেছে।
গতকাল বুধবার বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এরই মধ্যে এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। দুটি ঘটনার ভিডিও থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনোটিতেই কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে ঢাবির ঘটনায় বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দুঃখপ্রকাশ
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কার্যালয়ে ঢাবি ও জাবিরেরঘটনা দুটি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন স্বরাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে অপরাধীকে আইনের হাতে তুলে দিতে হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘তাঁরা তো (শিক্ষার্থী) সবচেয়ে শিক্ষিত। একজন অপরাধ করলে তাঁকে আইনের হাতে সোপর্দ করেন। আইন তো নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার নেই কারো।’
আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ
এসব ঘটনা নিয়ে আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয়। ওই পোস্টে বলা হয়, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করেছে ছাত্র নামধারী কয়েকজন বহিরাগত যারা সবাই ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সামনে এমন ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে? আমরা এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই এবং একই সঙ্গে ভিডিও ফুটেজ দেখে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবি জানাই।
একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হত্যার ঘটনা ঘটে। একইভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে একজনকে। আমরা সকল হত্যা ও নির্যাতনের বিচার চাই। এভাবে দেশে অরাজকতা চলতে পারে না।
প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রশিবির
এ দুটি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক সাদিক আবদুল্লাহ স্বাক্ষরিত এই বিবৃতিতে ছাত্র শিবিরের নেতারা নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
ছাত্রদেরকে সব ধরনের মব জাস্টিস বা মব কিলিং বন্ধ করার জন্য জোরালো আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিষ্ক্রিয়তা এড়িয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনতার বিচার বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
জাহাঙ্গীরনগরে প্রতিবাদ মিছিল
এদিকে, এই ঘটনার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি বের করা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দিক প্রদক্ষিণ শেষে রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ মিছিল শেষ করেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নানা স্লোগান দেন। পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুততম সময়ে আইনের আওতায় আনারও দাবি জানান।
ঢাবিতে বিক্ষোভ, তদন্ত কমিটি
মব জাস্টিসের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা।
এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল কর্তৃপক্ষ সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে হলের আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক ড. আলমগীর কবিরকে।
দুই হত্যা যেভাবে হলো
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদকে দেখেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। পরে তাকে কয়েক দফা মারধর করে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও শামীমকে বেশ কয়েকবার মারধর করা হয়।
পরে তাঁকে আশুলিয়া পুলিশের হাতে তুলে দিলে গুরুতর আহত অবস্থায় গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে রাত ১১টার দিকে তিনি মারা যান। নিহত শামীম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, গত ১৫ জুলাই রাতে উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থানরত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শামীম।
অপরদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত তোফাজ্জলের বাড়ি বরিশালের বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠাল তলি ইউনিয়নে। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, চোর সন্দেহে তোফাজ্জলকে আটকের পর গেস্টরুমে নিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেখানে তাকে রাত ১০টা পর্যন্ত দফায় দফায় মারধর করে শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে ওই যুবককে ক্যান্টিনে বসিয়ে ভাতও খাওয়ানো হয়। এরপর পুনরায় মারধর করা হয়।
পরে রাত ১২টার দিকে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান কয়েক শিক্ষার্থী। সেখানে চিকিৎসক তোফাজ্জলকে মৃত ঘোষণা করলে ওই শিক্ষার্থীরা মরদেহ রেখেই সরে যান।
এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ক্যাম্পাসের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। কেউ চুরি করতে আসলেও তাঁকে পিটিয়ে হত্যার অধিকার কারো নেই। ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দায়ীদের শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় হলের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করা হবে।