আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটি রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। নিজেদের ইতিহাসে এত কঠিন সংকটে আর পড়েনি দলটি। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই অসংখ্য মামলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব মামলার এজাহারের ঠিক নাই, ঘটনার সময়কাল ঠিক নাই। এমনকি যাদের তারাও মামলার বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন। আসামি করা হচ্ছে ঢালাও। ফলে এসব মামলা নিয়ে উঠছে বিভিন্ন প্রশ্ন।
বিষয়টি নজরে এসেছে অন্তবর্তীকালীন সরকারেরও। গায়েবি ও ঢালাও মামলার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে প্রধান বিচারপতির অভিভাষণ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এ প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার গায়েবি মামলা, ঢালাও মামলার কালচার শুরু করেছিল। আমরা সেটা থেকে বের হতে চাই। মানুষের মনে অনেক ক্ষোভ আছে, অনেক অসন্তোষ আছে, এসব গায়েবি মামলা দেখার অভ্যস্ততা আছে। অনেকের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা হয়ে যাচ্ছে।’
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারও সমালোচিত হয়েছিল ঢালাও মামলার জন্য। বিএনপির মামলার তথ্য ও সংরক্ষণ শাখার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে গত ২৫ জুলাই পর্যন্ত বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭১টি মামলা হয়। এসব মামলা আসামির সংখ্যা ৪০ লাখের ওপরে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরের ৫০ থানায় ১৭ হাজার ৫৮৩টি মামলা রয়েছে বলে দাবি বিএনপির।
দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একই পথ বেছে নিয়েছে বিএনপি। কেননা এখন যেসব রাজনৈতিক মামলা হচ্ছে এসবের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাদী বিএনপি ও তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। বিভিন্ন অভিযোগে প্রতিদিনই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি এসব মামলায় আসামি করা হচ্ছে বিগত সরকারের আমলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় সাবেক আমলাদেরও। শুধু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই করা হয়েছে প্রায় দুই শ মামলা। এর মধ্যে অন্তত দেড় শ মামলায় আনা হয়েছে হত্যার অভিযোগ।
ঢালাও মামলা না করতে বিএনপি থেকেও আহ্বান আছে। গত ২৮ আগস্ট গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যেকোনো মানুষের বিরুদ্ধে শত্রুতা থাকলেই মামলা দেওয়া হচ্ছে। মামলাগুলো নেওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যাতে যাচাই করে নেয় যে কোনটি সম্ভব, কোনটি সম্ভব নয়। প্রাথমিক যে তদন্ত, সেটা করা দরকার, তা না হলে একটু ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলে তার নাম দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, অভিযোগ নিয়ে গেলে পুলিশ তা প্রাথমিকভাবে যাচাই–বাছাই করে মামলা হিসেবে নেওয়ার কথা। এখানে স্পষ্টতই প্রাথমিক যাচাই–বাছাই হচ্ছে না। আদালতে মামলা করতে গেলে ম্যাজিস্ট্রেট জবানবন্দি গ্রহণ করে বাদীকে পরীক্ষা করবেন। কিন্তু সম্ভবত এগুলো হচ্ছে না। যাচাই-বাছাই করে মামলা নেওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।
আইনজীবীরা বলছেন, ফৌজদারি মামলায় এফআইআর বা এজাহারকে মামলার মৌলিক ভিত্তি বলে মনে করা হয়। এর কোনো শব্দ পরিবর্তন করা যায় না। কিন্তু সংশোধিত এজাহার বলে কিছু নেই। এটি বিচারে গ্রহণযোগ্য হয় না। আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই সেসবের ঘটনার কোনো মিল নেই। আর ফৌজধারি অপরাধের ক্ষেত্রে এজাহার পরে পরিবর্তন করা যায় না। মামলার বিবরণ ও এজাহারে আনা অভিযোগ না মিললে এসব মামলা ঠিকবে না বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, এজাহার একবারই হয়। এগুলো কিছুতেই কোর্টে টিকবে না। ক্রিমিনাল কেইস হলো স্থান, সময় এবং ঘটনা সংঘটনের স্থান। এই তিনটার হেরফের হলে তাহলে আর টেকে না। আর ফৌজদারি মামলায় এফআইআর বাইবেল হিসেবে পরিগণিত হয়। অর্থাৎ এর সামান্য দাড়ি, কমা পরিবর্তন হলে এটা বাদ।