জেন-জি হঠাৎই যখন এই প্রজন্মটা চলে এসেছে দেশ এবং সমাজের নেতৃত্বের জায়গায়। নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০১০-১২ পর্যন্ত যদি ধরি জেন-জিএর জন্মসাল — এদের বয়স এখন ১৫ থেকে ২৯-এর মধ্যে। খুব সোজাভাবে বলতে চাইলে জেন-জিরাই আজকের তরুণ।
ষাটের দশকে আমেরিকায় ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ থেকে শুরু করে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে যুব আন্দোলন বা আরব বসন্তের অভ্যুত্থান—তরুণেরা সর্বদা সীমানা পেরিয়ে একটি উন্নত বিশ্বের দাবিতে অগ্রণী ছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসও তরুণদের ত্যাগ ও অবদানে সমৃদ্ধ।
১৯৫২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে আরোপ করায় ছাত্ররাই প্রাথমিকভাবে প্রতিবাদ করেছিল এবং তাদের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আমাদের মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতির এনে দিয়েছিল। ১৯৬৯ সালে ছাত্র ও তরুণেরা পাকিস্তানের আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল।
এখন ২০২৪-বাংলাদেশের তরুণেরাই এনেছে ৩৬ জুলাই। তবে আজকের জেন-জি এবং পূর্ববর্তী প্রজন্মের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, যা বর্তমানের ডিজিটাল ক্ষমতায়ন, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অতুলনীয় সংযোগ দ্বারা প্রভাবিত।
সমালোচকেরা সব সময় বলে এসেছে যে জেন-জি অধৈর্য, শর্টকাট খোঁজে, সামাজিকতার ভিন্ন সংজ্ঞায় চলে । এই সমালোচনর পিছে আছে তাদেরকে বুঝতে না পারা, বা জেনারেশন গ্যাপ। এই গ্যাপের পেছনে সংগত কারণও আছে। জেন-জি জন্মগ্রহণ করেছে এবং বেড়ে উঠেছে এমন একটি বিশ্বে, যেখানে ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোন শুরু থেকেই তাদের জীবনের অংশ।
তাদের রয়েছে তথ্যের অভূতপূর্ব উৎস, যা তাদেরকে পূর্ববর্তী প্রজন্মের তুলনায় আরও অনেক সচেতন করে তুলেছে—সামাজিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে ও প্রযুক্তিগতভাবে।
বাংলাদেশের আজকের প্রেক্ষাপটে এই প্রজন্মকে বোঝা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৯ শতাংশ জেন-জি। আরও গুরুত্বপূর্ণ যে তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম যারা এখনো তরুণ থেকে মধ্যবয়স্ক, তারা জনসংখ্যার প্রায় ২১ শতাংশ এবং জেন-আলফা, জেন-জির পরের প্রজন্ম আরও ২৯ শতাংশ। সুতরাং জেন-জি নেতৃত্বে থাকলে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৯ শতাংশের ওপর তাদের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। এটা এক বিশাল ক্ষমতা।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে এটাই দেখেছি আমরা—যে আগুন জেন-জিদের হাত ধরে শুরু হয়েছে, তাতে একে একে যোগ দিয়েছে সবাই।
দেশ নানা সমস্যায় জর্জরিত রয়েছে বলে তাদের অনেক হতাশাও আছে আর সেই হতাশা থেকে তারা উন্নত জীবনের জন্য বিদেশেও চলে যেতে চায়, কিন্তু তারা চায় বাংলাদেশে উন্নয়ন আসুক।
তারা ক্রমাগত পুরোনো কথা শুনতে ইচ্ছুক নয়, তারা নতুন এবং বাস্তব কিছু চায়। তারা অবিলম্বে পরিবর্তন চায়, সাফল্যের সংজ্ঞা তাদের কাছে ভিন্ন। তারা তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চায়।
কারণ, তারা কেবল কথার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় না; তারা সমস্যার আসল সমাধান দেখতে চায়। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে এই প্রজন্ম জলবায়ু পরিবর্তন বা মানবাধিকারের প্রভাবের মতো বিষয়ে অনেক সচেতন; তারা সমাজ, দেশ এবং বিশ্বের পরিবর্তন আনতে উদ্বিগ্ন, সোচ্চার এবং সক্রিয়।
সব সময় ইন্টারনেটে থাকা বা কিছু এখনই করতে চাওয়ার তাড়না কিন্তু তাদের কিছু চ্যালেঞ্জেরও মুখোমুখি করে। গুজব বা ভুল তথ্য তাদের ডিজিটাল জগতের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বয়স্ক ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বা তাদের আশানুরূপ গতিতে ফলাফল না আসা তাদের মানসিক চাপের মধ্যে রাখে। অনলাইনে সব সময় সংযুক্ত থাকার চাপও অনেক; কেননা তাদের এখানে অনেক সক্রিয় থাকতে হয়। তাই তাদের মধ্যে পূর্ববর্তী প্রজন্মের তুলনায় উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং মানসিক চাপ অনুভব করার প্রবণতা বেশি।
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে আজকের জেন-জি বিশ্বদরবারে আমাদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রদের নেতৃত্বে তারা কেবল যোগাযোগ, বিনোদন, খেলার জন্য নয়; বরং সমন্বয়, সক্রিয়তা এবং শেষ পর্যন্ত সরকার পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা দেখিয়েছে, যা কয়েক সপ্তাহ আগেও ছিল অকল্পনীয়। বাংলাদেশের এখনকার যাত্রাটা রূপান্তরের যাত্রা। এই যাত্রায় একেকটি পরিবর্তন একেকটি মাইলফলক।
একটা বড় বিপ্লবের পরে ছোট ছোট অনেক বিপ্লবের মধ্য দিয়েই এখন যেতে হবে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে।
আগামীর ছোট-বড় কোনো বিপ্লবই যেন কোনোভাবেই সুযোগসন্ধানীদের কারণে নষ্ট হয়ে না যায়। দেশ রূপান্তরের লক্ষ্য নিয়ে এগোনোর মতাদর্শ আসলে একটাই—দেশের সবার, প্রতিদিন, প্রতিটি সমস্যা মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করে যাওয়া। অমিত সম্ভাবনার আমাদের এই বাংলাদেশ তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর মানে হচ্ছে তরুণদের সুন্দর চিন্তাধারার বাস্তবায়ন। তরুণদের স্বপ্ন আর অভিজ্ঞদের অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণের প্রয়োজন, প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে সততা ও স্বচ্ছতা।
previous post