হাসিনা আকতার নিগার , লেখক – কলামিস্ট
বিধাতার বিধান বড় অদ্ভুত। কখন কি হয় তা জানার বা বুঝার ক্ষমতা মানুষের নেই।যদিও মানুষ সব সময় ‘ আমি আমি ‘ করে।ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় কোন কালেই কোন শাসক কখনোই ভাবতে পারেনি সে ভুল করছে আর সে ভুলের কারনে তিনি ক্ষমতাচুত্য হয়েছে । কিন্তু নির্মম সত্য হল ভুল করে বলেই জনগণ শাসকের বিরুদ্ধে চলে যায়। আর শাসক ক্ষমতা হারায়।যা কালের ধারায় সাক্ষী হয়ে থাকে সারাজীবন।
ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতা হারিয়ে ৭৫ বছরের আওয়ামী লীগের ইতিহাসে দাগ লাগিয়েছে ১৬ বছরের ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার সরকার। বাকরুদ্ধ হয়ে দেখেছে জনগন ক্ষমতার জন্য একজন মা আরেক মায়ের সন্তানকে কি করে হত্যার হুকুমদাতার ভূমিকা পালন করেছে। মনে হয়েছে এ কোন শেখ হাসিনাকে দেখছি। তিনি তো আমাদের চেনা শেখ হাসিনা নয়।
স্বজন হারানোর বেদনা উনার আছে কিন্তু সন্তান হারানোর বেদনা হয়তো নেই বলে তিনি এ কাজটা করতে পেরেছেন। ক্ষমতার অহমিকায় আর চাটুকারদের মিথ্যা আশ্বাসে তিনি মনে করেছিলেন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোন দল নেই। কিন্তু যারা ৭১ কে ধারণ করে বংগবন্ধুর সোনার বাংলাকে ভালোবাসে তারা বুঝেছিল শেখ হাসিনা বিপথে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু দল বা সরকার নিয়ে সমালোচনা করার সুযোগ ছিল না তাদের।
কারণ আওয়ামী লীগ অন্ধ হয়ে প্রলয় বন্ধ করতে চেয়েছিল। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রধান্য দিয়ে আওয়ামী সরকার বার বার ক্ষমতা এসেছে ভোটবিহীন নির্বাচন দিয়ে। উন্নয়নের নামে যারা লুটপাট করেছে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যায়নি। দূর্নীতের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ছিল কেবল কথার কথা। সব মিলিয়ে আওয়ামী সরকারের কারণে অপমানিত হয়েছে বংগবন্ধু শেখ মুজিব ৫ জুলাইয়ের পর।
শেখ হাসিনা ভুলে গিয়েছিলেন বংগবন্ধু শুধু তার পিতা নন, তিনি বাংলাদেশের জাতির জনক। আর জাতির জনককে লাঞ্চিত হতে হয়েছে তার মেয়ের জন্য। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে যারা ধারণ করে তাদের কাছে শেখ হাসিনাকে জবাব দিতেই হবে একটা প্রশ্নের , ‘ তিনি কোন অধিকারের বলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে রসাতলে নিয়ে গিয়েছেন? সারা বিশ্বের কাছে ফ্যাসিবাদী সরকারের তকমা লাগিয়ে কি দিয়েছেন সাধারণ আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের?
শেখ হাসিনা যা বলে তাই হবে এটাই ছিল শেষ কথা। গনতন্ত্রের নামে রাজতন্ত্রের শাসন কায়েম করে জনগণের মনে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি করেছে। যার বিস্ফোরণ ঘটেছে ছাত্রদের আন্দোলনের মাধ্যমে। আর কবরে শেষ পেরেক ঠুকেছেন, ব্যক্তি ক্ষোভের কারনে জামায়েত ইসলামকে নিষিদ্ধকরনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার বিরোধী এ দলকে রাস্তায় নামার সুযোগ করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এটাই চরম সত্য। নিজের অন্যায়কে ঢাকতে গিয়ে যা করেছেন এর জবাব না দিলে আর একটা প্রতারণা করা হবে।
একটা দল বা আর্দশকে ধারণ করা মানে তার সমালোচনা করা যাবে না তা ভুল। দলের আত্মসমালোচনার করার সুযোগ থাকতে হবে। তাই আওয়ামী লীগকে এখন শোধরাতে হবে।কোন প্রোপাগাণ্ডা না ঘটিয়ে নিজেদের ভুলকে স্বীকার করে নিয়ে দলকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আসলে আওয়ামী লীগ বিএনপি থেকে শিক্ষা নিতে পারেনি বলেই নিজেদের অন্যায়কে নজর আন্দাজ করেছে দিনের পর দিন। সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা নৌকার পালে হাওয়া দিতে পারবে না তা তৃণমূলের বঞ্চিত নেতা কর্মীরা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু ক্ষমতার অহমিকাতে তাদের কথার মূল্যায়ন করা হয়নি।যার পরিনতি বর্তমান সময়।
জুলাই মাসে কি ঘটেছে তার সাক্ষ্য সাধারণ জনগন। মিথ্যার আশ্রয়ে এমন গনহত্যাকে অস্বীকার করা মানে নিজেকে বিবেকহীন অমানুষ মনে করা।৭১ এর মানে কেবল আওয়ামী লীগ নয়। মুক্তিযোদ্ধারা সকলে আওয়ামী লীগ করবে তা কিন্তু নয়। অথচ আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ আর দেশকে পৈতৃক সম্পত্তিতে পরিনত করেছে। যার ফলে দল আর নেতাকে এক পাল্লাতে রেখেছে বলেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ হয়ে উঠেছে পরিবারতান্ত্রিক দল। আর সে কারণে দল আর দেশের স্বার্থ উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যেতে পেরেছেন।
তবে তার এ যাওয়াটা মেনে নেয়া যায় না।প্রয়োজনে তিনি জেলে যেতেন। তিনি কি মনে করে ছিলেন তার নেতা কর্মীরা পাশ থাকত না। ১/১১ কে ভুলে গেছেন। ক্ষমতার দম্ভের প্রভাব কতটা ছিল তার প্রমান মিলেছে উনার কথা বার্তা আর আচার আচরনে। এখন সময় বলে দিবে ৭৫ বছরের আওয়ামী লীগকে তিনি কি জবাব দিবে।তার পিতার ভাস্কর্যগুলো নির্মাণ করেছেন যাদের বুদ্ধিতে তাদের মনে কিন্তু আঘাত লাগেনি এসবের ধবংস লীলা দেখে।
৭১ এর চেতনা আর বিশ্বাসীদের কিন্তু হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে জাতির জনকের অপমান দেখে। একটি লাশ দিয়ে রাজনৈতিক চাল যেখানে ঘুরে যায় সেখানে শত শত লাশের অভিশাপে অভিশপ্ত আওয়ামী লীগ। যা দেশের জন্য বড় লজ্জার। অবকাঠামো গত উন্নয়নের ফাঁক তালে অমানবিক আর দূর্নীতিবাজদের তিনি সুযোগ করে দিয়েছেন দেশকে ধবংস করার জন্য। কিন্তু সে সব কথা বলার জন্য কলম ছিল অবরুদ্ধ।
সাংবাদিকদের সকলে আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী ছিল না। কিন্তু জীবন আর জীবিকার কারনে অনেকেই বাধ্য হয়েছে পুতুল নাচের ভূমিকা পালন করতে।আসলে একজন কন্যা-জায়া- জননী হিসেবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ১৬ বছরের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই কথাটা সবচেয়ে বড় মিথ্যা মনে হয় যে কথা খুব ব্যংগ করে বলেছিলেন – ‘ শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ কখনো পালায় না,পালিয়ে যায়ওনি কখনো। ‘ তবে তিনি পালিয়েছেন এক সপ্তাহের ব্যবধান।এটাই বোধ হয় নিয়তির বিধান।
শিক্ষার্থীদের কোটার দাবিকে ঘুরিয়ে দিতে জামায়েতকে হাতিয়ার করার চেষ্টা ছিল বড় ভুল। জামায়েত ইসলামকে এতটা সহজ করে ভাবা উচিত হয়নি।এটা একটি সুসংগঠিত দল।আজ তারা ড: ইউনুসের সরকারের উপর ভর করে কোনঠাসা করছে বিএনপি সহ অন্যান্য দলকে।তারা নতুন বাংলাদেশ গড়ার নামে নিজেদের আর্দশকে স্থাপনের চেষ্টা করছে। তারাও চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করতে। এর জন্য দায়ী বিগত সরকার এতে কোন সন্দেহ নেই।
তবে এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন কতটা রয়েছে তা তারা ভুলে গেছে। বাংলাদেশের মাটিতে মৌলবাদের অবস্থান কোনদিন হয়নি বা হবে ও না। তারা বরাবরই অন্য দলের উপর ভর করে সংসদে এসেছে। তাই স্বাধীনতা বিরোধী দল আবার সংসদে যাবে এটা মানা যায় না। আর রাজনৈতিক পরিবর্তনে বিএনপি যদি জামায়েতকে পরিত্যাগ করে তবে সেটা হবে দলের জন্য প্রায়শ্চিত্ত।
৫ জুলাইয়ের পর সব কিছু মিলিয়ে দেশ ভালো নেই। নানাভাবে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। অস্থিরতা তৈরিতে কোন দলের অবস্থান কি তা পরিস্কার নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থান অনেকটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেনি অন্তবর্তীন কালিন সরকার। পুলিশ থেকে প্রশাসন কোথাও শৃঙ্খলা নেই।
আওয়ামী সরকারের দূর্নীতিবাজ পুলিশ ও প্রশাসনকে এত সহজে বদলে ফেলা যাবে না এটা যেমন সত্য তেমনিভাবে বর্তমান সময়ের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা জানে সাময়িক সময়ের এ সরকারের প্রতি অনুগত্য আগামী সময়ে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলে সহায়ক হবে না। তাই নানা তালবাহানা করে তারা সময় পার করাকে শ্রেয় মনে করে।
বাংলাদেশের জনগন এখন আর কোন কিছুতেই আহত হয় না বলে তারা ছাত্রলীগের বেশে শিবিরের দল গোছানোকে স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে করে।এক্ষেত্রে যখন একটি সরকার আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কাউকে চাকরি করতে দিবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়, সেখানে অন্য আর্দশের মানুষ ছল চাতুরী আশ্রয় নিবে এটাই বাস্তবতা । আর এসব কারনেই সারা দেশকে মনে হত আওয়ামী লীগ। আজ সব কিছু এতটাই পরিস্কার যে,সুস্থ চিন্তার বিবেকবান মানুষ হিসেবে দেশকে নিয়ে আশার আলো দেখতে ভয় পায়।
চারদিকে মনে হয় মেকি সব কিছু। নতুন প্রজন্মের নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে মনে হয়, এমন স্বপ্ন নিয়ে ৯০ এর আন্দোলনে যারা লড়াই করেছিল তাদের আন্দোলন যেমন ছিনতাই হয়েছে তেমনিভাবেই ২০২৪ সালের ৫ জুলাই ও রাজনৈতিক দলগুলো ছিনতাই করার চেষ্টা করছে। আর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়ে হামলা মামলা আর দূর্নীতিবাজদের সরকার যেমন প্রত্যাশা নয় একইভাবে ধর্মকে হাতিয়ার করে কোন দল সংসদে যাওয়া হবে বড় বেদনা দায়ক।
সুতরাং বাংলাদেশের রাজনীতিতে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে জনগনকে। নেতা পালিয়ে যেতে পারে কিন্তু সাধারণ জনগন চালিয়েই পালিয়ে যেতে পারে না।