সাঈদ ইফতেখার আহমেদ,
নিজ পরিচয় গোপন করে অন্য দলে ঢুকে রাজনীতি করবার ট্র্যাডিশন খুব সম্ভবত একমাত্র বাংলাদেশেই আছে। এ ধারা প্রথম শুরু হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, কমিউনিস্ট পার্টির (আজকের সিপিবি) হাত ধরে, পঞ্চাশের দশকে। সেসময় গণতন্ত্রী দল নামে তারা একটি পৃথক দলও গঠন করেছিলেন, যেটি মূল দলের পাশাপাশি কাজ করত।
রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপ, দল নিষিদ্ধ থাকা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে দলের সিদ্ধান্তে তাদের কিছু কর্মী আওয়ামী লীগে প্রবেশ করে আওয়ামী পরিচয়ে রাজনীতি করা শুরু করে। আওয়ামী নেতৃত্বের অনেকে বিষয়টা জানতেন; তারা এটা প্রশ্রয়ও দিতেন।
আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মনে প্রাণে “মার্কিনপন্থী” হলেও তিনি তাদেরকে শুধু প্রশ্রয় না, তাদের কাউকে কাউকে তার পত্রিকায় চাকুরীও দিয়েছিলেন।
এদেরই একজন ছিলেন “পিকিংপন্থী” হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক কামরুন্নাহার লাইলি—যিনি এরশাদের একসময়ের মন্ত্রী আনোয়ার জাহিদের প্রথম স্ত্রী ছিলেন। এরশাদের সাথে হাত মিলাবার আগে তিনিও “পিকিংপন্থী” কমিউনিস্ট এবং সাংবাদিক ছিলেন।
উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমলে আনোয়ার জাহিদ এবং কামরুন্নাহার লাইলি জেল থেকে এক সাথে বের হবার পর জেল গেটেই তাঁদের বিয়ে হয়েছিল—যেটা সেসময় বড় নিউজ হয়েছিল (আজকের দিনের ভাইরাল)।
আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ এবং আব্দুস সামাদ আজাদকে মনে করা হত আন্ডারকাভার কমিউনিস্ট। উল্লেখ্য, আশির দশকে মহিউদ্দিন আহমেদ এবং আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি অংশ বের হয়ে গিয়ে আবার বাকশাল গঠন করে। অবশ্য, এ প্রকল্পটিও আগের মত ব্যর্থ হয়।
আজকের সিপিবির পূর্বসূরিরা “মস্কোপন্থী” কমিউনিস্ট হিসেবে পরিচিত ছিল। ভাসানী-ন্যাপ ভেঙ্গে ন্যাপ (মোজাফফর) হবার পর সিপিবির কর্মীরা আওয়ামী লীগের পরিবর্তে মোজাফফর-ন্যাপে ঢুকে কাজ করতে স্বাছন্দ্য বোধ করে। অপরদিকে, “পিকিংপন্থীরা” কাজ করবার ক্ষেত্র হিসেবে ভাসানী-ন্যাপকে বেছে নেয়। মাওলানা ভাসানী বিষয়টা জানতেন এবং তাঁদেরকে স্নেহের চোখে দেখতেন।
১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত ঘোষণা করে বাকশাল নামক একক রাজনৈতিক দল গঠন করা হলে সিপিবি তাদের দল অফিসিয়াল ভাবে বিলুপ্ত করে বাকশালে যোগ দেয়। কিন্তু এতদিন পরে আবার জানা যাচ্ছে, দল বিলুপ্ত করবার কথা বলা হলেও সিপিবি গোপনে তাদের দলের একটা নিউক্লিয়াস অংশকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, যাতে প্রয়োজন পড়লে আবার দ্রুত দলকে দাঁড় করিয়ে ফেলা যায়।
সিপিবির এসব কৌশল আখেরে কোন কাজে লাগেনি—বরং দলটি নানাভাবে জনবিছিন্ন হয়ে প্রান্তীয় একটি দলে পরিণত হয়েছে। এর বিপরীতে আজকের বিএনপির কথা ভাবুন। গত সাড়ে সতের বছর যাবত তার ইতিহাসের চরমতম রাষ্ট্রীয় চাপ এবং নিপীড়নের মধ্য দিয়ে দলটি গেছে।
কিন্তু কোন অবস্থাতেই দলের কেউ আওয়ামী লীগ বা অন্য কোন দলের প্রবেশ করে কাজ করার কথা স্বপ্নেও ভাবে নাই। ভালো মন্দ যা কিছুই হোক, দলের ব্যানারে, দলের পরিচয়েই নেতাকর্মীরা থেকেছেন।
নিপীড়ন দেখে কেউ পালিয়ে যান নাই, হিম্মতের সাথে মোকাবেলা করেছেন। এমনকি ১৯৯৬ সালে গণআন্দোলনে দলটি ক্ষমতাচ্যুত হলেও, আজকের আওয়ামী লীগের মত তাঁদের কেউ পালিয়ে যাননি। সরকার ক্ষমতা ছাড়বার দিন সাহসিকতার সাথে সারা দেশে তারা মিছিল করেছেন। বস্তুত, এ হিম্মত থাকবার ফলেই আজকে দলটি বাংলাদেশের একটি প্রধান দল হিসেবে রয়ে যেতে পেরেছে।
আত্মপরিচয় যারা লুকায় মানুষ তাঁদের ভীতু অথবা সুবিধাবাদী ভাবে। ভীতু আর সুবিধাবাদীদের গণমানুষ তাঁদের নেতা মনে করে না—যদি করত, তাহলে সিপিবি আজকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হত।