সরকারী টাকায় দাদার নামে হাসপাতাল, বাবার নামে স্কুল ৫৬ কোটি টাকায় আইটি সেন্টার ॥ জনবিচ্ছিন্ন সড়কে ৮ সেতু বিলাস দাস,(উপঃ)পটুয়াখালী॥
সেতুর দুই প্রান্তের সড়কের অস্তিত্ব নেই,কাদামাটির সড়কে নেই চোখে পড়ার মত লোকজন ও যান চলাচলের গতি। দুই যুগ আগে নির্মিত কৃতিম বাঁধে খালটির জলপ্রবাহ বন্ধ। অথচ সেই খালের উপরে নির্মিত হচ্ছে ৮টি গার্ডার সেতু। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল দপ্তর (এলজিইডির) আয়রন ব্রীজ প্রকল্পের আওতায় জনগুরুত্বপূর্ন সেতু গুলো নির্মিত হচ্ছে জনবিচ্ছিন্ন স্থানে।
অপরিকল্পিত এ উন্নয়নে ৩৩ কোটি টাকার অধিক খেসারত দিচ্ছে সরকার। শুধু সেতু নয়,জনপ্রশাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের সচিব পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ বাড়ী ও গ্রামে শত কোটি টাকার প্রকল্প বাগিয়েছেন ফয়েজ আহম্মদ ওরফে ফয়েজ মোল্লা। সবশেষ ২০২০ সালে বাংলাদেশ কর্ম-কমিশন (পিএসসি‘র) সদস্য নিযুক্ত হন তিনি। আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পূর্বমূহুর্তে নিজ এলাকায় আপন ভাগ্নে রুবেল মোল্লার নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে গিয়ে জবাদদিহিতায় পরেন তিনি।
এরপর থেকেই তাকে ঘিরে গুঞ্জন ওঠে নানা মহলে। পটুয়াখালী সদর উপজেলার ভুরিয়া ইউনিয়নের ভায়লা গ্রামে নিজ বাড়ী। যদিও গ্রামের বাড়ীতে তার পরিবার বসবাস করছেনা। অথচ সেই বাড়ী ঘিরে সরকারী অর্থে বাস্তবায়ন করেছেন মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্র, মসজিদ,ঈদগাহ মাঠ,পুকুর সংস্কার,কমিউনিটি ক্লিনিক,হাইটেক র্পাকসহ নানা অবকাঠমো। এসব প্রকল্পের অধিকাংশ চুড়ান্তের পথে। তথ্যমতে এতে ব্যয় হচ্ছে অন্তত একশ কোটি টাকা।
অনুসন্ধান ও সরেজমিন বলছে-সাবেক জনপ্রশাসন‘র সচিব ফয়েজ আহম্মদের বাড়ীর সামনে কাশিপুর খালের উপরে সাড়ে ৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকায় ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে ৯৬ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি গার্ডার সেতু। নির্মিত সেতুর পশ্চিম প্রান্ত সাবেক সচিবের বাড়ীর প্রবেশদ্বার হলেও পূর্বপ্রান্তে জনগুরুত্বহীন একটি সড়ক।
সুত্রমতে ২০২০-২১ অর্থ বছরের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল দপ্তর(এলজিইডি) আয়রন ব্রীজ প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালীতে একাধিক সেতু নির্মান প্রকল্প হাতে নেন। এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত ৮টি সেতু বাস্তবায়ন এলাকায় নির্বাচিত হয় ফয়েজ আহম্মদের নিজ গ্রামে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে-আয়রন ব্রীজ প্রকল্পের পরিচালক(পিডি) ও পটুয়াখালী এলজিইডিকে প্রভাবিত করে নিজ এলাকায় এসব প্রকল্প বাগিয়েছেন তিনি। যদিও এসব নিয়ে গনমাধ্যমে কথা বলতে অনিচ্ছা পটুয়াখালী এলজিইডির কর্মরতরা।
এছাড়াও তৎকালিন সময়ে পটুয়াখালী এলজিইডিতে কর্মরত প্রকৌশলীরা অন্যত্র চলে যাওয়ায় প্রকল্প নথিপত্র যাচাই-বাছাইয়ে জটিলতা রয়েছে। একই প্রকল্পে অর্ন্তভুক্ত মতি সাহার বাড়ী সংলগ্ন শৌলা খালের উপরে আরো একটি সেতু নির্মানাধীন। ৫১ মিটার দৈর্ঘ্যরে এসেতুতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৯১ লাখ,৭০ হাজার টাকা। ৬ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে দেখা গেছে-র্নিমানাধীন সেতুর পূর্বপ্রান্তে জনবিচ্ছিন্ন কাদামাটির সড়ক এবং সেতুর পশ্চিম প্রান্তে বাগান বাড়ী। সরেজমিনে সড়কের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
ফয়েজ আহম্মদের বাড়ীর দরজা সংলগ্ন কাশিপুর খাল জুড়ে থেকে ১ থেকে দেড় কিলোমিটারের আওতায় নানা ক্যাটাগড়িতে নির্মিত হচ্ছে ৩৩ কোটি ১৮ লাখ ৭২ হাজার টাকার ৮টি গার্ডার সেতু। অথচ পৌরশহর থেকে ৫শ মিটার দুরত্ব জৈনকাঠির চন্দনবাড়ীয়া খালের উপরে দুই যুগ ধরে একটি ভাঙ্গা আয়রন সেতু ব্যবহার করে আসছেন স্কুল-কলেজ শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ হাজারো মানুষ।
ভাঙ্গা সেতুটি ব্যবহারে অহরহ দুর্ঘটনার খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতেন ভুক্তভোগীরা। তবুও নজরে আসেনি কর্তৃপক্ষের। তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন ক্ষেত্রে নদী রক্ষা কমিশন ও পাউবোর কাছ থেকেও অনাপত্তি নেয়নি এলজিইডি।
সুত্র বলছে-তৎকালীন সময়ে জেলা আওয়ামীলীগ এর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাড. গোলাম সরোয়ার ডিসির সভায় অপরিকল্পিত সেতু র্নিমানের প্রতিবাদ করেন। গোলাম সরোয়ারের সেই প্রতিবাদ আমলা তন্ত্রের প্রভাবে টেকেনি। জলাশয় দখল করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রসঙ্গে পবিপ্রবির পরিবেশ বিজ্ঞানী পাপড়ি হাজরা বলেন, নদী বা খালে স্থাপনা তৈরিতে পানি প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হবে এবং নদীর গভীরতা এবং পানির গুণাগুন নষ্ট হবে। এতে পানিতে দ্রবীভুত অক্সিজেন জীব বৈচিত্রের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
সরেজমিন বলছে-সাবেক সচিব ফয়েজ আহম্মদের গ্রামের বাড়ীতে শুনশান নিরাবতা। সচিবের দ্বিতীয় তলা একটি ভবনসহ কাচাপাকা মোট ৭ টি বসতঘর। ঘর গুলোতে বর্তমান বসবাসের সংখ্যা ১২-১৫ জন। সচিবের পরিত্যক্ত বসতঘর থেকে ৩০-৩৫ মিটার দুরত্বে ব্যক্তিগত পুকুর।
পটুয়াখালী এলজিইডি ২৫ লাখ টাকায় ওই পুকুরের প্যালেসেডিং, ওয়াকওয়ে এবং ঘাটলা নির্মান করেছে। ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর পটুয়াখালী এলজিইডির তৎকালিন উপজেলা প্রকৌশলীর দেয়া চুড়ান্ত বিলে এ তথ্য রয়েছে। বাড়ীর পুকুর থেকে ৫০ মিটার দুরত্বে ফয়েজ আহম্মদের “দাদা কালু মোল্লা”র নামে নির্মিত হয়েছে ১০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্র।

২০১৭-১৮ অর্থ বছরে পটুয়াখালী স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ৪ কোটি, ৯৪ লাখ টাকায় এটি নির্মান করেছে। ২০১৮ সালের ৩০ মার্চ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রনালয়ের সচিব থাকাকালিন সময় প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন ফয়েজ আহম্মদ। মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রটির পরিদর্শিকা মোসা.রুনা আক্তার বলেন-আগষ্ট মাসে দুই নারীকে নরমল বাচ্চা প্রসব এবং ২৫০ রোগীকে নানা চিকিৎসা দিয়েছেন।
অথচ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় একজন মেডিকেল অফিসার,একজন স্যাকমো চিকিৎসক, দুইজন ওয়ার্ডবয়,একজন আয়া,একজন পিয়ন এবং একজন নিরাপত্তাকর্মী কর্মরত আছেন। যাদের বাৎসরিক বেতন-ভাতায় ব্যয় হচ্ছে অন্তত ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা। মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রটির সীমানা প্রাচীর ঘেঁষা উত্তর পাশে পূর্ব ভায়লা কমিউনিটি ক্লিনিক।

২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ২৩ লাখ,২৯ হাজার টাকায় ব্যয়ে স্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তর এটি র্নিমান করেছে। কমিউনিটি ক্লিনিক সংলগ্ন বাড়ীর অভ্যন্তরীন সড়কের উত্তর পাশে একটি ঈদগাহ পারিবারিক কবরস্থান এবং নারী-পুরুষ মসিজদ। ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে জেলা পরিষদ ও এলজিইডি এঅর্থের যোগান দেন বলে নিশ্চিত করে নির্ভরযোগ্য।
তবে সরকার পতনের উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতিতে দাপ্তরিক তথ্য মেলেনি। গ্রামীন আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে পুরুষ মসজিদে গড়ানুপাতে ১০-১২ জন নামাজে অংশ নেন। নারীদের জন্য নির্মিত মসজিদটি বন্ধ থাকে বলে জানান ফয়েজ আহম্মদের বাড়ীর নিকট আত্মীয় আনসার মোল্লা। মসিজদ ও ঈদগাহের পূর্বপাশে নির্মিত একটি সাইক্লোনসেল্টার।
২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ২ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয়ে ত্রান ও দূর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এটি বাস্তবায়ন করেছে। একই বছর দূর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের অর্থায়নে ৮১ লাখ, ৫২ হাজার টাকায় ব্যয়ে বাড়ীর আঙিনা পর্যন্ত সড়ক নির্মিত হয়। এছাড়াও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের অর্থায়নে বাবার ফজলুল করিম মোল্লার নামে মাধ্যমিক বিদ্যালয় করেছেন ফয়েজ আহম্মদ।
বর্তমানে বাড়ীর প্রবেশদ্বারে ৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বহুতল ভবন সজ্জিত শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার নির্মান প্রকল্প চলমান রয়েছে। আইসিটি মন্ত্রনালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথোরিটি তত্ত্বাবধায়নে ঢাকার একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সিমেক প্রাইভেট লিঃ কোম্পানী কাজটি করছেন। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ইঞ্জিনিয়ার মো.সাকিব হোসেন এ তথ্য জানান। আওয়ামীলীগ সরকারের ক্ষমতা আমলে উচ্চপদে থেকে বিভিন্ন দপ্তরকে প্রভাবিত করে বাড়ী ও গ্রাম সাজাতে সরকারী প্রকল্প বাগিয়েছেন তিনি।
সুত্রমতে ফয়েজ আহম্মদ ১৯৮৭ সালে বিসিএস (কৃষি) ক্যাডার এবং ১৯৮৮ সালে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯৮-২০০১ সাল পর্যন্ত বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব ছিলেন। ২০০২-২০০৬ সাল পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
২০০৯-২০১২ সাল পর্যন্ত রাজবাড়ী ও চট্টগ্রাম জেলার ডিসি। ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যান বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব পরে ওই বছরের ২৬ এপ্রিল সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০১৮ সালে ২৪ জুন জনপ্রশাসন সচিব পদে যোগ দেন। ২০২০ সালে অবসরে গেলে ৭ জানুয়ারী ৫ বছর মেয়াদে সরকারী কর্ম কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।