আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ সংশোধন করে এমন সুযোগ রাখছে যে, অপরাধ ঠেকাতে না পারায় বিচার করা যায়। স্পষ্টতই শেখ হাসিনাকে ইঙ্গিত করে এটা করা হচ্ছে। আবার সংগঠনকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিষিদ্ধের সুযোগ রাখা হচ্ছে।
এনওয়াই বাংলা স্পেশাল
মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রধানত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে, সরকার পতনের পর এবার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগকেও সেই আদালতেই বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
জুলাই-অগাস্টে আন্দোলনের সময় প্রাণহানির ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের কথা আসিফ নজরুলই প্রথমে বলেছিলেন। এরপরই একের পর এক অভিযোগ জমা পড়তে থাকে আওয়ামী লীগ প্রধানের বিরুদ্ধে।
যে ট্রাইব্যুনাল গঠন হয়েছিল যুদ্ধাপরাধের বিচারে, সেই ট্রাইব্যুনালে রাজনৈতিক সংঘাতের বিচারের উদ্যোগ আইনিভাবে কতটা সম্ভব, এই প্রশ্নের মধ্যে এবার আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।
সংশোধনীগুলো এমনভাবে করা হচ্ছে, যেখানে অপরাধে জড়িত না থাকলেও অপরাধ ঠেকাতে না পারার দায় দিয়ে সাজা দিয়ে দেওয়া সম্ভব। আর ট্রাইব্যুনাল আইনে সংগঠন তথা দলের সাজার বিষয়ে কিছু বলা না থাকায় এই বিষয়েও একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংগঠনকে একটি সময়ের জন্য নিষিদ্ধ করার বিধান রাখা হচ্ছে।
যত সময় আগাচ্ছে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের উদ্দেশ্য তত স্পষ্ট হচ্ছে। শেখ হাসিনাকে ফাঁসানোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোতে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার বিধান রেখে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন আইন উপদেষ্টা।
যেভাবে আগাতে চান আসিফ নজরুল
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ এ যা যা লেখা আছে, তাতে আসিফ নজরুল ও তার সরকারের উদ্দেশ্য সাধন কঠিন। তাই তিনি আটঘাট বেঁধেই নামতে চাইছেন। এই আইন পাল্টে দিতে চাইছেন।
এরই মধ্যে আইন উপদেষ্টা সংশোধনের একটি খসড়া প্রস্তুত করে ফেলেছেন যেখানে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগকেও ফাঁসানো সহজ হয়।
আইনটির ৩ নম্বর ধারায় সংশোধন এনে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় একটি ব্যাপক ও সিস্টেমেটিক আক্রমণের অংশ হিসেবে গুম, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক যৌনকর্ম, জোরপূর্বক গর্ভধারণ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
লিঙ্গ ও সাংস্কৃতিক কারণে যদি কোনো সাধারণ নাগরিকের উপর ব্যাপক ও ‘সিস্টেমেটিক’ আক্রমণ করা হয়, তাও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। বর্তমান আইনে এটা নেই।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষ গত কয়েক বছর ধরেই গুমের অভিযোগ আনছে।
এরই মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে এ সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়েছে। তার বিরুদ্ধে যেমন দেড়শটিরও বেশি হত্যা মামলা হয়েছে, তেমনি ট্রাইব্যুনালেও হত্যা, নির্যাতন, অপহরণসহ নানা ধরনের ১৪টিরও অভিযোগ জমা পড়েছে।
আসিফ নজরুল ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের দিন গুমের অভিযোগও জমা পড়েছে। অভিযোগ দায়ের করেন রাজধানীর বাসাবো এলাকার ব্যবসায়ী এনামুল কবির। তাকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে ১০ দিন ‘গুম’ করে রাখার কথা বলা হয়েছে অভিযোগে।
প্রধান কৌঁসুলি তাজুল ইসলাম বলেন, ২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর ডিবির তৎকালীন অফিসার মশিউরের নির্দেশে বাসাবো থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় এনামুলকে। চোখ ও হাত-পা বেঁধে তাকে ফেলে রাখা হয়। ২৬ নভেম্বর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।সেদিন তার বাসাবোর অফিস থেকে এক বস্তা ‘বিস্ফোরক সদৃশ বস্তু’ উদ্ধার করার অভিযোগে মামলা করে পুলিশ।
ওই ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ২৫ জনকে আসামি করে অভিযোগ করেছেন এ ব্যবসায়ী।
কিন্তু নিজামী, মুজাহিদ বা অন্য যাদের সাজা হয়েছে, তারা সবাই সশরীরে অপরাধে অংশ নিয়েছেন অথবা নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে তথ্য প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে তো তা নেই।
তাহলে কীভাবে ফাঁসানো যায়?
আসিফ নজরুল চাইছেন আইনে এমন একটি ধারা সংযোজন হবে, যাতে বলা থাকবে ‘এ আইনের অধীনে অপরাধ হতে পারে এটি জানা সত্ত্বেও যদি কোনো সংস্থা, সংগঠন, দল, সংঘবদ্ধ চক্র, সত্তার নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তাকেও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’
অর্থাৎ আপনি অপরাধ ঠেকাতে পারেননি, কাজেই আপনার সাজা হবে।
আসিফ নজরুল সংশোধনী নিয়ে আলোচনায় বলেছেন, তারা বিচারে স্বচ্ছতা রাখতে চান। এ জন্য আইনে ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত চাইলে তার পক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন বলেও সুযোগ রাখা হচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তারা আইনি সুরক্ষাই পাচ্ছেন না, সেখানে ট্রাইব্যুনালে কেউ দাঁড়াতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্নও আছে।
দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের সুযোগ কোথায়
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের একাধিক রায়ে জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ বলা হয়েছে। এরপর দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের উদ্যোগও নিয়েছিল ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
তবে আইনে সংগঠনের বিচারের বিষয়ে কিছু বলা নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একাধিকবার আইন সংশোধনের কথা বললেও সেটি আর আগায়নি।
তবে আসিফ নজরুল তার উদ্দেশ্য সাধনে আগাতে চাইছেন দ্রুত। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে এই সুযোগ রাখতে চাইছেন।
তার প্রস্তাবিত অষ্টম সংশোধনীতে কোনো রাজনৈতিক দল যদি এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ করে তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনালে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগসহ সব সহযোগী সংগঠনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
জামায়াত নেতাদের বিচারের প্রতিশোধ মিশন
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস জয়ের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে আগের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ব্যর্থতার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের বিচারের অঙ্গীকার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তখন থেকেই বলে আসছেন।
এই বিচারে ২০১০ সালে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, যে বিচারে ১৯৭৩ সালেই আইন করে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার।
এই ট্রাইব্যুনালের রায়ে একাত্তরে আলবদর বাহিনীর নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে গণহত্যা ও নির্যাতনে সরাসরি জড়িত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিলেও পরে আপিল বিভাগের রায়ে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। অন্যদিকে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দিলেও আপিল বিভাগ রায় পাল্টে দেয় আমৃত্যু কারাদণ্ড।
বাংলাদেশে জামায়াতের গুরু গোলাম আযমেরও ৯০ বছরের সাজা হয়েছে এই ট্রাইব্যুনালে, যেটি গঠন হয় শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের কারণে।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সেই শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার সদস্য এবং দল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের বিচারের উদ্যোগকে যে প্রতিশোধ মিশন, তা এরই মধ্যে স্পষ্ট করেছেন আসিফ নজরুল।
ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী তথা চিফ প্রসিকিউটর করা হয়েছে এর আগে যুদ্ধাপরাধীদের আইনজীবী তাজুল ইসলামকে। তদন্ত সংস্থাতেও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে জামায়াত সংশ্লিষ্টদেরকে।
বিরোধিতারও সুযোগ নেই?
কিন্তু প্রশ্ন হল, রাজনৈতিক সংঘাতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধ বা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করে বিচার করা সম্ভব কিনা। আর সেটি করলেও তার দায় প্রধানমন্ত্রী বা তার দলের ওপর দেওয়া যায় কিনা।
এসব ঘটনায় দেশে প্রশ্ন তোলার মত সোচ্চার মানুষ থাকলেও তার বক্তব্য যে সংবাদ মাধ্যমে ছাপার সুযোগ নেই, সেটি স্পষ্ট করেছে সরকার।
তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে সাফ ইঙ্গিত দিয়েছেন, আওয়ামী লীগের কোনো বয়ান ছাপা যাবে না। তারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটিকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে আক্রমণ করে যাচ্ছে আন্দোলনে নামার পর থেকেই।
সাংবাদিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে ২৩ সেপ্টেম্বর তরুণ এই উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চাই, অবশ্যই। কিন্তু আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন রেখে যেতে চাই, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সীমা কতটুকু?’
পরে নিজেই বলেন, ‘আমরা জানি, স্বাধীনতা মানে স্বাধীনতাই। এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ চলে না।’
পরক্ষণেই এই সীমা নির্ধারণ করে তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে বা স্বাধীনতার মাধ্যমে ফ্যাসিস্টদের প্রচারণা করা যাবে কি না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে ফ্যাসিস্টদের পারপাস সার্ভ (উদ্দেশ্য সাধন) করা যাবে কি না। সেই বিষয়টি আপনাদের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম।’
অর্থাৎ নাহিদের বক্তব্যে স্পষ্ট, যে আওয়ামী লীগকে তারা ফ্যাসিস্ট হিসেবে তুলে ধরছেন, তার কোনো কথাই ছাপা যাবে না।
ইঙ্গিতটি স্পষ্ট, ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ভাষ্যের বাইরে কোনো বক্তব্য গণমাধ্যমে ছাপা পছন্দ করবে না।