জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কারমূলক উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার পদক্ষেপগুলোকে মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন তিনি।
গতকাল বুধবার ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে টুর্ক এ বিষয়ে তার সমর্থন জানান এবং বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন প্রচেষ্টার প্রতি সংস্থাটির ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেন।
জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বৈঠক সম্পর্কে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে একটি বার্তা প্রকাশ করা হয়। নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় গতকাল সকালে এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা হয় এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগের প্রশংসা করা হয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে বিশেষভাবে ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে টুর্ক বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের নেওয়া বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগের প্রশংসা করেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক সফরের তৃতীয় দিনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফলকার টুর্কসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বনেতা ও সংস্থাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, ইউএসএআইডি প্রশাসক সামান্থা পাওয়ার, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এসব বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের চলমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেন।
পাকিস্তানের সঙ্গে নানা স্তরে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা পুনরুজ্জীবিত করার আলোচনা
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা পুনরুজ্জীবিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বৈঠকে দুই নেতা বিভিন্ন স্তরে সহযোগিতা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এক্স হ্যান্ডলে এক পোস্টে জানানো হয়েছে, নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় গতকাল সকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব তুলে ধরেন। তিনি এ উদ্যোগে পাকিস্তানের সমর্থন কামনা করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এ প্রস্তাবে সমর্থন জানান এবং সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে দেশগুলোকে ধাপে ধাপে এগিয়ে আসার পরামর্শ দেন।
শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায় খোলা উচিত। আমাদের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করা খুবই জরুরি।’
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের বস্ত্র ও চামড়া খাতে বিনিয়োগের জন্য তাঁর দেশের আগ্রহের কথা প্রকাশ করেন।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস দুই দেশের মধ্যে যুব কর্মসূচি বিনিময়ের প্রস্তাব করেন।
দুই শীর্ষ নেতা দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের আলোচনার যৌথ কমিশন আবার শুরুর বিষয়ে আলোচনা করেন।
অ্যামেরিকার সঙ্গে চার খাতে সহযোগিতায় মনোযোগ
যোগাযোগ, জ্বালানি, বিচারব্যবস্থা ও তারুণ্যের বিকাশে সহযোগিতা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে অ্যামেরিকার সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী বাংলাদেশ।
গতকাল নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অ্যামেরিকার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) প্রশাসক সামান্থা পাওয়ারের বৈঠকে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় গতকাল সকালে প্রধান উপদেষ্টার স্থানীয় আবাসস্থলে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক্স হ্যান্ডেলে জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ইউএসএআইডির প্রশাসকের সঙ্গে বৈচিত্র্যময় ক্ষেত্রে অ্যামেরিকার সঙ্গে সহযোগিতা জোরদারের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সহযোগিতার এসব বিষয়ে মধ্যে রয়েছে যোগাযোগ, জ্বালানি, বিচারব্যবস্থা ও তারুণ্যের বিকাশ।
‘রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এগিয়ে আসুন’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উচ্চপর্যায়ের এক আলোচনায় তিনি এই আহ্বান জানান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের সতর্ক হতে হবে। এ সংকটের সমাধান না হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র অঞ্চল সমস্যায় পড়বে। তাই আমাদের অবশ্যই এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।’
ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন করে ভাবার প্রস্তাব দেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রথমত, আমরা চাই জাতিসংঘ মহাসচিব যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সব পক্ষের উপস্থিতিতে একটি সম্মেলনের আয়োজন করুক।’ সম্মেলনে সংকটের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নতুন এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সমাধানের উপায় কী হতে পারে, তেমন প্রস্তাব আসতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ড. ইউনূস বলেন, দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ যৌথভাবে পরিচালিত ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান’ কার্যক্রমে নতুন করে প্রাণশক্তি যোগ করার প্রয়োজন। যেহেতু এখন রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় করার মতো তহবিলের অভাব রয়েছে। তাই রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়া আরও জোরদার করতে হবে।
তৃতীয় প্রস্তাবে ড. ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই আন্তরিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দ্বারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বৈষম্য, রাষ্ট্রহীনতা ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি বন্ধ করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মহাপরিচালক অ্যামি পোপ বলেন, ‘এ সংকট সমাধানে আমাদের আরও কাজ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে।’
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় অ্যামেরিকার আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া অ্যামেরিকার পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং তাদের আশ্রয়দানকারী বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর জন্য প্রায় ১৯ কোটি ৯০ লাখ অ্যামেরিকার ডলারের নতুন সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেন। এই সহায়তা রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদের মানবিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাংলাদেশে তাদের দীর্ঘস্থায়ী আশ্রয় প্রদানের ক্ষেত্রে সহায়তা করবে।
এই অ্যামেরিকার সহায়তা জীবন রক্ষা, বিশেষ করে সহিংসতা ও নিপীড়নের কারণে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা, আশ্রয় ও খাদ্য সরবরাহে সহায়তা করবে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে বাংলাদেশে অবস্থানরত কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে পাঠানো ভিডিও বার্তায় বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভুলে যাওয়া চলবে না।
previous post